সমগ্র বিশ্বের সব নেতাদের মনে এখন একটা প্রশ্ন হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছে। ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয় ইসলামিক স্টেট বা আইএসের গতি কিভাবে রোধ করা যায়? প্রশ্নটি মনে আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রশ্নটা মনে আসাটা যতোটা সহজ কাজ এর সমাধান হয়তো ততোটাই কঠিন। আর সেটা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছেন বিশ্ব নেতারা। কারণ গত মাসে মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেছিলেন, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে আইএস হামলার কোনো হুমকি নেই। কিন্তু তার এক সপ্তাহের মধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়ায় ভয়াবহ বন্দুক হামলায় ১৪ জনের অকাল মৃত্যু ঘটে। আর সেটা যে আইএস করেছে সেটাও পরে জানা যায়। একইভাবে প্যারিস হামলার বিষয়েও আগে কিছু জানতে পারেনি বিশ্বের প্রভাবশালী সব গোয়েন্দা সংস্থা।
আইএস নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এদের আদর্শ, কৌশল জানতে এখনো গলদঘর্ম গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তারা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি যে, কিভাবে এদের অপপ্রচারের রাস্তাগুলো বন্ধ করা যায়। কিভাবে এদের অর্থের উত্স বন্ধ করা যায়। অথচ প্রচার এবং অপপ্রচারের যে ব্যবস্থা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে তার সদর দপ্তর কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে। সম্প্রতি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও সিলিকন ভ্যালিকে আইএসের অপপ্রচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়েছেন। এমনকি বিশ্বের সোশ্যাল মিডিয়া (ফেসবুক, টুইটার এবং গুগল) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রীও।
নানা প্রশ্নের মাঝে একটা প্রশ্ন খুব কম শোনা যায়। আর তাহলো আইএসের উদ্দেশ্যটা আসলে কি? কি চায় এই সংগঠনটি? আর তারা তাদের লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমেই বা কি করতে চায়? এই লক্ষ্য পূরণে তারা কি কি কাজ করতে চায়। জঙ্গিগোষ্ঠীটি ইরাকে প্রথমে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। তারা কয়েক মাইল এলাকা প্রথমে দখল করে । এরপর হঠাত্ করেই ইরাক ও সিরিয়ার বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। তাদের এই আকস্মিক নিয়ন্ত্রণ বিশ্বের তাবত্ নেতা, গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের হতভম্ব করে দেয়। কারণ এমন দৃশ্য আগে যেমন কখনো দেখা যায়নি, তেমনি এমন দৃশ্য দেখার আশাও কেউ করেনি।
এক বছর আগে মার্কিন প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক গোপন সাক্ষাত্কারে মেজর জেনারেল মাইকেল কে. নাগাতা জানান, আমরা তাদের আদর্শকে পরাজিত করতে পারিনি, এমনকি তাদের আদর্শকে বুঝতেও পারিনি। এই জেনারেল পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন বিশেষ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। আইএস কিন্তু তাদের লক্ষ্যের বিষয়টি গোপন রাখেনি। তারা প্রথম দিকেই ঘোষণা দিয়েছিল-তাদের মূল উদ্দেশ্য সারা বিশ্বে যুদ্ধ বাধিয়ে খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাদের লক্ষ্য, সারা বিশ্বে কৃত্রিম একটা সীমানা তৈরি করা এবং বিশ্ব মানচিত্রে পরিবর্তন ঘটানো। তারা শিয়া মুসলমানদের নির্মূল করতে চায়। কারণ, তারা মনে করে, শিয়ারা মুসলমান নয়। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধ শুরু হলেও তারা চায় সেটা ইউরোপ এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে দিতে। তারা ইসলামি যুদ্ধ করতে চায়। তারা নাস্তিকদের বিরুদ্ধে একটা বড় ধরনের যুদ্ধে অংশ নিতে চায়। তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে যে অপপ্রচার চালায় তার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরিফ এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের বার্তার মধ্যে পার্থক্য অনেক। কিন্তু তাদের সমর্থকদের দেখাতে চায় যে তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনে সফল।
আইএস তাদের প্রচারের জন্য মূলত অনলাইন ম্যাগাজিন ‘দাবিক’ ব্যবহার করে। তাদের এই ম্যাগাজিনের টাইটেলটা কিন্তু কোনো দুর্ঘটনাবশত আসেনি কিংবা করা হয়নি। দাবিক হচ্ছে উত্তর সিরিয়ার একটি শহরের নাম। এটা এখন আইএসের নিয়ন্ত্রণে। ইসলামিক প্রোফেসি অনুযায়ী, রোমের সেনাবাহিনীই হবে ইসলামের সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনী রোম এবং জেরুজালেম দখল করবে। আইএস মনে করে, জিহাদ ছাড়া কোনো খেলাফত প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। ‘দাবিক’-এ বলা হয়েছে, জিহাদ সবসময়ই থাকবে এবং রাখতে হবে। তারা বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে তাদের বানানো পতাকা ওড়াতে চায়। আর সেই উদ্দেশ্যে জিহাদ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। তারা মনে করে, অন্তত সিরিয়া, ইয়েমেন এবং ইরাকের সেনাবাহিনী যতোদিন না একসঙ্গে জেগে উঠবে ততোদিন জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। এই প্রচারণার মাধ্যমে তারা তাদের দলে মানুষ ভেড়াতে চেষ্টা করে এবং এর মাধ্যমে তারা মুসলমানদের একটি বার্তাও দিতে সচেষ্ট হয়। তারা বলে, একদিন সময় তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। ফলে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়াই শ্রেয় এবং ইতিহাসও সেটাই সাক্ষ্য দেয়। ২০১৪ সালে আইএসের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদীও ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই খেলাফতের খলিফা হওয়াটাই তার প্রধান লক্ষ্য। মুসলমানদের প্রতি এটা তাদের কর্তব্য যা কয়েক শতাব্দী ধরে হারিয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন পাপের কারণে মুসলমানরা সেটা হারিয়েছিল এবং তাদের উচিত সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো। তবে বাগদাদী তথা আইএসকে নিয়ে এখন সত্যিকারের মুসলমানদের মনেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাহলো বাগদাদী আসনে মুসলিম কি না এবং আইএস মুসলমানদের স্বার্থে কাজ করছে কিনা। কারণ, সম্প্রতি ব্রিটিশ খ্যাতিমান দৈনিক ডেইলি মেইলের এক খবরে জানানো হয়েছে, আইএসের আহতদের চিকিত্সা দিচ্ছে ইহুদিবাদী ইসরাইল।
আইএস মনে করে, খেলাফত প্রতিষ্ঠাই মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায়। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা দখল করতে হবে এবং তা দিনকে দিন বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্লেষক গ্রামি উড দ্য আটলান্টিকে লিখেছেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কারণ এজন্য একটা অঞ্চল দখলের দরকার হয় এবং সেটা হতে হয় দৃশ্যমান। এর একটা কর্তৃপক্ষও থাকা দরকার। এই কর্তৃপক্ষের অধীনে সবাই থাকবে। আইএসের আদর্শ নিয়ে কাজ করেন বাহরাইনের তুর্কি আল-বিনালি। তিনি ২০১৩ সালে লিখেছিলেন, খেলাফতে ক্ষমতা, আকাঙ্ক্ষা এবং রাজনৈতিক সামর্থ্য থাকা দরকার হয়। আর সেটা এখন ইসলামিক স্টেটে আছে। তারা ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে এবং তারা এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচুর সম্পদও দখলে নিয়েছে।
২০১১ সালে সিরিয়ায় যখন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয় তখন বাগদাদী তার একটি যোদ্ধা বাহিনী সিরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন তিনি। আইএস তাদের দাবিকে আবু মুসাব আল জারকাওয়ির নানা উদ্ধৃতি দেয়। তারা তাকে তাদের আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা মনে করেন। এই আল-কায়েদা নেতা ২০০৬ সালে নিহত হন। জারকাওয়ি ২০০৪ সালে দাবিকে লিখেছিলেন, ‘আগুনের স্ফুলিঙ্গ ইরাকে জ্বলেছে এবং এর উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে হবে যতক্ষণ না ক্রুসেডার আর্মি জ্বলে পুড়ে না যায়। আল্লাহ সেটাই বলেছে’।
দাবিক ম্যাগাজিন দেখলেও তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়। এই জঙ্গিগোষ্ঠীটি তাদের ম্যাগাজিনের অনলাইন সম্পাদনার প্রত্যেকটি শাখায় একটা ব্যানার শিরোনাম করে। তাহলো, ‘রিমেইনিং’ এবং এক্সপান্ডিং’ অর্থাত্ আছে এবং বাড়বে।
লিবিয়ায় আইএস তাদের আধিপত্য বিস্তারের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের এবং সেনাবাহিনীর দুর্বলতায় সিরত এবং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা দখল করেছে। লিবিয়ায় সিরিয়া থেকে অনেক যোদ্ধা পাঠানো হয়েছে। তারা লিবিয়ায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং বাগদাদী স্বয়ং সেখানে যুদ্ধের দেখভাল করছেন। লিবিয়া থেকে মিসর এবং তিউনিশিয়ায়ও সহজে আক্রমণ করা যায়। তারা এখন ইয়েমেন, আফগানিস্তানেও যাচ্ছে। গ্রামি উড লিখেছেন, আইএস মূলত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া এবং সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চায়। বাগদাদী গত বছর বলেছিলেন, শিগগিরই তোমরা আমাদের মুখোমুখি হবে এবং আমরা সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছি। গ্রামি উড লিখেছেন, আইএসের এখন মূল উদ্দেশ্য, মার্কিন সেনাবাহিনীকে সম্মুখযুদ্ধে নিয়ে আসা এবং তাদের পরাজিত করা। কারণ তখন খেলাফত রক্ষায় বিশ্বের মুসলমানরা তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেবে।
সিএনএন অবলম্বনে
No comments:
Post a Comment