বাংলাদেশের অর্থনৈতির একটি বড় খাত জনশক্তি রপ্তানি। কারণ প্রতিবছর প্রচুর বাংলাদেশি চাকরির খোঁজে পাড়ি দিচ্ছে অজানার দেশে। কিন্তু এরপরও গত কয়েক বছর ধরে কমছে বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশিদের পরিমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের মে পর্যন্ত বিদেশে গেছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার বাংলাদেশি। যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৬ লাখ ৮৫ হাজার শ্রমশক্তি রপ্তানি হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়ের পরিমান কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে— বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতন, মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক ও অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শ্রমশক্তি রপ্তানিতে বিভিন্ন দেশের বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি। তবে এ কারণগুলোর মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক টানাপড়েন আর তেলের দাম কমে যাওয়ার প্রভাবেই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিটেন্স এতোটা কমেছে। একই সাথে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো বাংলাদেশি প্রবাসীদের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি‘র চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন বলেন, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছে। যার কারণে আমরা হারাচ্ছি সেইদেশগুলোর শ্রমবাজার। তাই তিনি মনে করেন, সরকাররে অতিদ্রুত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে যে ধরনের কাজের চাহিদা বাড়ছে সে অনুযায়ী কর্মক্ষম জনশক্তি তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একই সাথে জনশক্তি রপ্তানির জন্য নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য আমাদের শ্রম রপ্তানির অন্যতম গন্তব্য, তাই ওই অঞ্চলের পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জনশক্তি রপ্তানির একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই জনশক্তি রপ্তানি বিশ্লেষক আরও বলেন, ভারত-শ্রীলংঙ্কার মতো দেশগুলো শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্য পাঠালে বিভিন্ন চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিক পাঠায়। যার কারণে এসব দেশের শ্রমিকরা মধ্যেপ্রাচ্য গিয়ে কোনো প্রকার সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু এদিক থেকে বাংলাদেশির কোনো শ্রমচুক্তি না থাকায় সেই দেশগুলোতে বাংলাদেশিরা সামাজিক ও আর্থিক সমস্যায় পড়ছে। তাই তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি লোক কাজ করছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যর হিসেব হিসেব ধরলে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরবে গিয়েছে। তবে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পযর্ন্ত শ্রমিক যাওয়া বন্ধ ছিলো সৌদি আরবে। কিন্তু তার পরও অবৈধ ভাবে এই সাত বছর প্রায় মাত্র ১ লাখ ১৭ হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরবে পাড়ি দেয়। পরে ২০১৫ সাল থেকে আবার বাংলাদেশিদের যাওয়া শুরু হয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে সৌদি আরবে প্রায় ২ লাখ ৪৮ হাজার লোক গেছে।
অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২ লাখ ২৭ হাজার জনশক্তি রপ্তানি হয়। এরপর ২০০৯-১০ সাল থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত সেখানে শ্রম রপ্তানি প্রায় বন্ধ থাকে। অর্থবছর ২০১০ থেকে অর্থবছর ২০১৫ পর্যন্ত ৬ বছরে মাত্র ১৬ হাজার ৩২৭ জন বাংলাদেশি যায় সেখানে। তবে সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রপ্তানিতে মিশ্রধারা দেখা গেছে। বিগত ১০ বছরে জনশক্তি রপ্তানিতে অস্থিরতা বিরাজ করলেও সিঙ্গাপুরে স্থিতিশীলতা দেখা গেছে। অর্থবছর ২০১০ হতে অর্থবছর ২০১৩ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রপ্তানি আগের বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা বেড়ে ৬০ হাজার ৩৫৫ জনে দাঁড়ায়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব অল্প কিছু দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যাওয়ার সংখ্যাটা বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো শ্রমবাজারগুলোতে বাংলাদেশিদের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। আর তাই দ্রুত এ বিষয়েটি সরকারের বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। আর তা না হলে আমাদের দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক খাতটি হুমকির মুখে পড়তে পারে।
No comments:
Post a Comment