প্রবাসী শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল আর দেশের রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করেছে। সেই প্রবাসীদের আর্থিক অবস্থা অনেক ক্ষেত্রে স্বচ্ছল হলেও কখনো কখনো খুবই ভয়াবহ। মাঠের ফসলি জমি, গোয়ালের গরু, পুকুরের মাছ, এমনকি নিজের ভিটে-মাটি বিক্রি করে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে গ্রামের সহজ সরল মানুষটি জীবন-জীবিকার সন্ধানে ভাগ্য উন্নয়নে এক সময় প্রবাসে পাড়ি জমায়। অথচ তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের পরিণতি হয় বিদেশে মানবেতর জীবনযাপন কিংবা দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু।
কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়ে স্বজনদের জীবিকা চালিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেও অনেকে তাদের একটা নিরাপদ বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। এমন সব প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট কিনতে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি)। সংস্থাটি শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের কথা মাথায় রেখে ১ জুলাই থেকে ‘প্রবাস বন্ধু’ নামে একটি ঋণ কর্মসূচি চালু করেছে। আপাতত ঋণ নিতে পারবেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বাড়ি নির্মাণে একক ঋণ, গ্রুপ ঋণ ও ফ্ল্যাট ঋণ—এই তিনটি শ্রেণিতে ঋন প্রক্রিয়া ভাগ করেছে বিএইচবিএফসি। বাড়ি নির্মাণের চেয়ে ফ্ল্যাট কেনায় সুদের হার একটু বেশি। আর ঋণ পরিশোধ করা যাবে ৫, ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছরের মেয়াদে মাসিক কিস্তিতে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বেশি হলে কিস্তির পরিমাণ কম হবে। বিএইচবিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এই প্রথম আলাদা আবাসন ঋণ কর্মসূচি চালু করা হলো। আমরা মনে করছি, এতে স্বদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অন্যদিকে তাঁদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা ভালো পরিবেশে বসবাসের সুযোগ পাবেন।’
ঋণ আবেদনকারীর জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন আবেদনকারীকে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক ও প্রবাসী ও ঝামেলামুক্ত জমির মালিক হতে হবে। আবেদনকারীর বিদেশে অবস্থানের সময়কাল হতে হবে কমপক্ষে তিন বছর। বাংলাদেশের যেকোনো তফসিলি ব্যাংকে ঋণের আবেদনকারীর সঞ্চয়ী হিসাব থাকতে হবে এবং ঋণে নির্মিত বাড়ি বা ফ্ল্যাটের সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য বাংলাদেশে থাকেন এমন কাউকে আমমোক্তার নিয়োগ করতে হবে।
ঋণের আওতায় বাড়ি নির্মাণে যত টাকা ব্যয় হবে, তার ৭০ শতাংশ ঋণ দেবে বিএইচবিএফসি। বাকি ৩০ শতাংশ থাকতে হবে গ্রাহকের নিজস্ব বিনিয়োগ। ঋণের টাকাও পাওয়া যাবে কয়েকটি কিস্তিতে, একবারে নয়। ঋণের আবেদনপত্রের সঙ্গে বিদেশে চাকরির সনদ ও রেসিডেন্ট পারমিটসহ সব কাগজপত্র কনস্যুলেট বা দূতাবাসের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। অবশ্য কেউ তা না চাইলে বিএইচবিএফসির নির্ধারিত এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমেও কাগজপত্রের স্বচ্ছতা যাচাই করিয়ে নিতে পারেন।
বিএইচবিএফসি সূত্রে জানা গেছে, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১৫ বছর হলে প্রতি ১ লাখ টাকায় ১০ শতাংশ সুদের ক্ষেত্রে মাসিক কিস্তি ১ হাজার ৭৫ টাকা, ৯ দশমিক ৫ শতাংশ সুদের ক্ষেত্রে কিস্তি ১ হাজার ৪৪ টাকা ২০ পয়সা, ৯ শতাংশ সুদের ক্ষেত্রে ১ হাজার ১৪ টাকা এবং ৮ দশমিক ৫ শতাংশ সুদের ক্ষেত্রে মাসিক কিস্তি ৯৮৪ টাকা ৭০ পয়সা। একক ঋণ ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় বাড়ি নির্মাণে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত একক ঋণ নেওয়া যাবে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা বাদে দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা সদর এলাকায় বাড়ি নির্মাণে সর্বোচ্চ ঋণের পরিমাণ ৬০ লাখ টাকা, তবে সুদের হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। পল্লী এলাকায় বাড়ি নির্মাণে ঋণের পরিমাণ ৫০ লাখ, সুদের হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। পল্লী এলাকা বলতে উপজেলা সদর, উপশহর (পেরি আরবান) এবং বিশেষ বাণিজ্য কেন্দ্র বা গ্রোথ সেন্টারকে বোঝানো হয়েছে।
গ্রুপ ঋণ নিয়ে বাড়ি নির্মাণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত গ্রুপ ঋণ দেবে বিএইচবিএফসি। এ ছাড়া বিভাগীয় ও জেলা সদরে বাড়ি নির্মাণে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ এবং পল্লি এলাকায় বাড়ি নির্মাণে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যাবে। ফ্ল্যাট ঋণের ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় ফ্ল্যাট কিনতে বিএইচবিএফসি ঋণ দেবে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে সুদের হার ১০ শতাংশ।
বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে ফ্ল্যাট কেনায় ঋণ মিলবে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত। সুদের হার এখানেও ১০ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলে ফ্ল্যাট কেনার ঋণের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টাকা ও সুদের হার ৯ শতাংশ।
১১ বছর যাবৎ মালয়েশিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী কামরুজ্জামান দোলন বলেন, প্রবাসীদের জন্য এটি অনেক বড় সুখবর। একই সঙ্গে দেশের আবাসন খাতের জন্যও এটি ভালো সংবাদ। এতে করে নিশ্চিন্তে অনেক প্রবাসী দিন কাটাতে পারবে প্রবাসে। তিনি আরও বলেন, প্রবাসে বসবাসরত সবাই পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তায় থাকেন। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই পুরুষ। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাই প্রবাস জীবন বেছে নেয়া পুরুষদের পরিবারের জন্য নিরাপদ বাসস্থান পাওয়া একটি স্বস্তির খবর।
No comments:
Post a Comment