Social Icons

Thursday, July 13, 2017

মৌলভীবাজারে ৫ লক্ষাধিক পানিবন্দী মানুষের মানবেতর জীবনযাপন


উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এখনো পানিতে টইটুম্বুর মৌলভীবাজারের তিনটি হাওর ও শতাধিক নদী। ফলে হাওরগুলো রয়েছে উত্তাল। বন্যার পানিতে ডুবছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট। বাদ যাচ্ছে না অপেক্ষাকৃত উঁচু মসজিদ কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। প্রতিদিনই হাওরে পানি বাড়ছে। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে স্থানীয় ১৪টি বড়ো নদীর পানি। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এসব এলাকার বাসিন্দারা। ইতোমধ্যে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আর বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে।
এ বছর পাহাড়ি ঢল আর অবিরাম ভারী বৃষ্টির কারণে কয়েক দফা বন্যা দেখা দেয়। তৃতীয় দফার এ বন্যায় জেলায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হাওর এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত পরিবারগুলোও বাড়ি ফিরছে।
চলতি মাসে কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে জেলার হাওরগুলোর পানি যেনো ফেঁপে উঠছে। আর নদীগুলোর পাড় ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। নতুন করে ফের বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন হাওর ও নদী তীরের কয়েক লাখ মানুষ।
কয়েক দফা বন্যায় এ বছর সব হারিয়ে নি:স্ব কৃষককূল। আগের দু’বারের বন্যায় ধান আর সবজি ক্ষেত শেষ হয়ে গেলেও এখন বানের পানি গ্রাস করেছে বসতবাড়ি। মাথা গোঁজার ঠাঁইও যেনো নেই। ঘরবাড়ি বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সব হারিয়ে তারা চরম অসহায়। জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিতে হচ্ছে অন্যত্র। বর্তমানে এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হাওর ও নদী তীরের মানুষ।
এ বছর অকাল বন্য আর অতি বৃষ্টিতে নাকাল জেলার নদী ও হাওর তীরের বাসিন্দারা। চৈত্রের অকাল বন্যায় বোরো ধানের পর মরেছে মাছ। এরপর হাঁস, জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদ। একে একে সব হারিয়ে দিশেহারা হাওরপাড়ের লোকজন। এমন বির্পযয় এর আগে কখনো দেখেনি এ অঞ্চলের মানুষ। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর বিপর্যস্ত মানুষজন। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত হয় নদীপাড়ের মানুষ। হঠাৎ আকস্মিক বন্যায় নদীর পাড় ভেঙে প্লাবিত হয় তীরবর্তী গ্রামগুলো। ধান, মাছ, সবজি আর ঘরবাড়ি হারিয়ে নি:স্ব হয় কৃষি ও মৎস্যজীবি পরিবারগুলো।
গত কয়েক সপ্তাহ আগে টানা ভারী বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে কয়েক দফা বন্যার কবলে পড়ে হাওর ও নদীপারের মানুষ। একাধিকবার বন্যাকবলিত হয়ে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হন লোকজন। প্রথম দফা বন্যায় হাওর ও নদীতীরের প্রায় চার লাখ মানুষ (জেলা প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে আরো দেড় লাখ মানুষ।
একের পর এক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে লোকজন দিশেহারা হলেও আশার বাণী ছাড়া সরকারি তরফে এখনও নেই পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা-এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী লোকজনের।
দুর্ভোগগ্রস্তরা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যে ত্রাণসামগ্রি এসেছে তা খুব অল্পসংখ্যক লোকই পেয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন পর্যাপ্ত ত্রাণ না থাকায় বঞ্চিত হয়েছেন।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি ও মৎস্যজীবি লোকজন জানান, কয়েক মাসের মধ্যে বার বার বন্যায় আক্রান্ত হওয়ায় আউশ ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ। গবাদি পশুগুলোর খাদ্য সংকটও তীব্র। 
চলতি মাসে কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে জেলার সাতটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর শহরের অধিকাংশ মানুষ বন্যাকবলিতহয়ে পড়েন। এর মধ্যে অন্যতম জেলার বড়লেখা, কুলাউড়া, জুড়ী ও কমলগঞ্জ (আংশিক) ও রাজনগর উপজেলা।
ভুক্তভোগীরা জানান, কিছুদিন আগে বন্যায় এসব এলাকার কৃষিজমি ও মৎস্য খামার ডুবে গেলেও এখন ডুবছে তাদের ঘরবাড়ি। হাকালুকি হাওরপারের তিনটি উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ২৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন সহস্রাধিক পরিবারের লোকজন। পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় অধিকাংশ বন্যাক্রান্ত লোক আশ্রয় নিয়েছেন তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।
বড়লেখায় বন্যায় পাঁচটি ইউনিয়নের অন্তত ৭০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। ঘরে পানি প্রবেশ করায় স্থানীয় স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে ২৬৭টি পরিবার। অনেকেই উঁচু এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছেন। অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুবে আছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। ফলে জনদুর্ভোগ চরমে।
ভুক্তভোগীরা জানান, হাকালুকি হাওরতীরবর্তী বড়লেখার সুজানগর ইউপির দশঘরি, রাঙ্গিনগর, বাড্ডা, ঝগড়ি, পাটনা, ভোলারকান্দি, উত্তর বাঘমারা; তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা, ইসলামপুর, খুটাউরা, বাড্ডা, নুনুয়া, পাবিজুরী, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, পশ্চিম গগড়া, পূর্বগগড়া, বড়ময়দান, গাগড়াকান্দি, তেলিমেলি, গোপালপুর, হাউদপুর, বর্ণি ইউনিয়নের পাকশাইল, সৎপুর, কাজিরবন্দ, নোওয়াগাঁও, উজিরপুর, কাজিরবন্দ, রাজারহাটি এবং দাসেরবাজার ইউনিয়নের চানপুর, অহিরকুঞ্জি, উত্তর বাগিরপার, দক্ষিণ বাগিরপার, পানিশাইল, ধর্মদেহী, চুলারকুড়ি, কোদালী, ধলিরপাড়, নেরাকান্দি, মাইজমজুড়ি, মালিশ্রী গ্রামগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, হাকালুকি হাওরপারের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল, জয়চন্ডী, কাদিপুর, কুলাউড়া, ব্রাহ্মণবাজার, ভাটেরা ও বরমচাল ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। এ উপজেলায় আটটি আশ্রয় কেন্দ্রে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। জুড়ী উপজেলায় চারটি আশ্রয় কেন্দ্রে শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রিত লোকজন পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন।
তবে ওই সব উপজেলার প্রশাসন সূত্র জানায়, তারা অল্প হলেও শুকনো খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করছেন। আর পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরেও জানিয়েছেন। জুড়ী উপজেলার চার ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে আছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের বেলাগাঁও, সোনাপুর, শাহাপুর, রাজাপুর, নিশ্চিন্তপুর, গোবিন্দপুর, জাঙ্গিরাই, নয়াগ্রাম, শিমুলতলা, ইউসুফনগর; পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের বাছিরপুর, খাগটেকা, তালতলা, কালনিগড়, হরিরামপুর, কৃষ্ণনগর, ভবানীপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কমলগঞ্জ উপজেলায় ধলাই নদীর পাড় ভেঙে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ২৫টি গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। দফায় দফায় বন্যা আর নদী ভাঙনে চরম ক্ষতিগ্রস্ত জেলার অন্যতম সবজি চাষের এই উপজেলাটি।
একই অবস্থা জেলার রাজনগর, মৌলভীবাজার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায়ও। নদী ভাঙন আর হাওরের উপচে পড়া পানিতে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন এই তিন উপজেলার অন্তত দেড়লাখ মানুষ। জেলার হাকালুকি, কাউয়াদিঘি, হাইল হাওর আর মনু, কুশিয়ারা, ধলাই, ফানাই, কন্টিনালা, সুনাই ও জুড়ী নদীর তীরবর্তী লোকজনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেশি। 
এ বছর আগাম বন্যায় বোরো ধানের পর আউশ ধান ও সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, স্থানীয় হাওর ও নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাসের কারণেই এমন দুর্যোগের শিকার হয়েছেন মানুষজন। মানবসৃষ্ট কারণে জেলার প্রতিটি হাওর, নদী, ছড়া, খাল, বিল দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া এবার দুর্ভোগগ্রস্তদের সংখ্যা তাই একটু বেশিই। দীর্ঘদিন থেকে খননহীন নদীগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ স্থায়ীভাবে মেরামত না করায় বার বার ওই সব বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়।
এ বিষয়ে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)’র নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তী জানান, উজানে ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ কারণে ত্রিপুরার কয়েকটি স্থানেও বন্যা দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার পানি আমাদের দিকে আসে। ফলে আমাদের নদী ও হাওরে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমেই।
তিনি আরো জানান, স্থানীয় হাওর ও নদীগুলো খনন ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে অনেকটা স্থায়ী সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম জানান, পাহাড়ধ্বসের আশঙ্কায় সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে। মার্চ মাসের দুর্যোগের পর দফায় দফায় আশ্রয় কেন্দ্রসহ আক্রান্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রি বিতরণ অব্যাহত আছে।
জেলা প্রশাসক আরো জানান, বর্তমানে হাওর তীরবর্তী এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত অনেক পরিবারই বাড়ি ফিরছে।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates