Social Icons

Wednesday, March 23, 2016

গর্ভপাতের কারণ ও প্রতিকার

গর্ভধারণ করার পর প্রসবকাল পর্যন্ত চল্লিশ সপ্তাহের পরিক্রমায় জমাট পানি থেকে পূর্ণাঙ্গ শিশুর অবয়ব পর্যন্ত বিভিন্ন আকার-প্রকার ধারণ করে। এর প্রথম চতুর্থ সপ্তাহ থেকে আটাশ সপ্তাহের মধ্যে যদি কোনো কারণে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয় তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে মিসক্যারেজ, বাংলায় বলে গর্ভপাত। লিখেছেন ডা: নাদিরা বেগম
২৮ সপ্তাহ থেকে ৩৭ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হলে তাকে বলা হয় প্রিটার্ম লেবার। তা ছাড়া ৩৭ সপ্তাহ থেকে ৪০ সপ্তাহের মধ্যে যদি গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু হয় তখন তা টার্ম লেবার অর্থাৎ এ সময় গর্ভস্থ শিশু পূর্ণ অবয়ব পায়।
মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত হয় আর্লি স্টেজে অর্থাৎ পাঁচ মাসের মধ্যে। এ সময় গর্ভস্থ শিশুর তেমন অবয়ব গড়ে ওঠে না। কিন্তু ২৮ সপ্তাহের পরে, যা প্রিটার্ম লেবার বলে পরিচিত। এ সময় মানবিক আকৃতির অনেকটাই হয়ে যায়। কোনো কারণে সেই শিশু যদি মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন তাকে বাঁচানো প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। কারণ আমাদের দেশে অতটা উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি আর্থিক সঙ্কটের কারণে আনা সম্ভব হয় না।
মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা শিশু বাইরের শীত গরম বায়ুদূষণের প্রতিকূল অবস্থা বুঝতে পারে না। ফলে অপরিণত শিশুর শ্বাসকষ্ট হয়, ওই শিশুর পাকস্থলি, লিভার, থার্মোরেগুলেটরি সেন্টার এবং ইমিউনিটি ডেভেলাপ করে না।
এ ছাড়া লাঙ্গসের মধ্যে যে অ্যালাভিউলাস মেমব্রেন থাকে, যা দিয়ে অক্সিজেন যাতায়াত করে। একে সাহায্য করে সারফেকটেন্ট নামে এক রকম কেমিক্যাল, এর অভাবে অপরিণত শিশুর শ্বাসকষ্ট হয়। তার পরিণতিতে মৃত্যুও হতে পারে।
আমরা যেকোনো খাবার খাই না কেনো, তা হজম রেচনের পর শরীর পায় কার্বোহাইডেট, শর্করা, প্রোটিন, পানি ও মিনারেল। হজম রেচনের পরিক্রমায় শিশুর অপরিণত পাকস্থলি থাকায় খাবার ভেঙে প্রসেস করতে পারে না। এ ছাড়া শিশুর লিভার অপরিণত থাকায় সহজেই জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। যার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক।
আমাদের ব্রেনের মধ্যে থার্মোরেগুলেটরি সেন্টার আছে যা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরের তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট অর্থাৎ স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকে। কিন্তু এ সময় শিশুর ক্ষেত্রে থার্মোরেগুলেটরি সেন্টার অপরিণত থাকার কারণে গরম বা ঠাণ্ডা পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। ফলে হিট বা কোল্ড স্ট্রোক হয়। পরিণামে মৃত্যুও হতে পারে।
তা ছাড়া, ওই সব শিশুর ইমিউনিটি পাওয়ার ডেভেলপ করে না। অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে না। ফলে ভাইরাস আক্রান্ত বা সংক্রমিত হয়ে অপরিণত শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। আমাদের দেশে এই সব প্রিম্যাচিওর বেবি বা অপরিণত শিশুকে বাঁচানো কষ্টসাধ্য।
গর্ভপাত কেন হয়
গর্ভস্থ শিশু, মা, বাবার বা দুইজনের শারীরিক ত্রুটির কারণে গর্ভপাত হয়। মায়ের যদি হাইপ্রেসার, ডায়াবেটিস, হঠাৎ কোনো কারণে জ্বর হয়। এ ছাড়া রক্ত ও জরায়ুর সংক্রমণ, রক্তে টক্সোপ্লাজমার সংক্রমণ হলেও জরায়ুতে টিউমার বা ফাইব্রয়েড থাকলে গর্ভপাত হতে পারে। অনেক সময় বাচ্চা ধরে রাখার ক্ষমতা জরায়ুর থাকে না। ডাক্তারি পরিভাষায় বলে সারভাইবাল ইনকমপেটেন্টস। জরায়ুর পানি কম থাকলে গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু হতে পারে। তা ছাড়া প্রসবের সময় পেরিয়ে গেলে জরায়ুর পানি কমতে বা ঘন হতে থাকে। একসময় গর্ভস্থ শিশু দুর্বল হতে হতে মারা যায়।
মা ও শিশুর দুইজনের শারীরিক ত্রুটি থাকার কারণে শিশু বিকলাঙ্গ, মাথা বড় বা পেটের কোনো অংশ ডেভেলপ করে না। তখন গর্ভপাত ঘটতে পারে।
মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের আরো অনেক কারণ আছে। যেমন, জেনেটিক ডিফেক্ট, ক্রোমোজোমের অ্যাবনরমালিটি, হরমোনাল ডিফেক্ট ইত্যাদি। হরমোন প্রজেস্টোরন ও এইচসিজি মায়ের জরায়ুকে ইরিটেট করা থেকে শান্ত রাখে। অর্থাৎ ক্রমাগত ধাক্কা থেকে মুক্ত রাখে। ফলে বাচ্চা মাতৃগর্ভে অক্ষত থাকে। কিন্তু এই দুই হরমোনের পরিমাণ বেড়ে গেলে বা কমে গেলে, ইনব্যালান্সড হলে, বাচ্চা বেরিয়ে যেতে পারে।
আবার থাইরয়েড হরমোন কম থাকলেও বাচ্চা বেরিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া প্রোলাক্টিন নামে আরো এক রকম হরমোন রয়েছে মায়ের শরীরে। এই হরমোন বেশি থাকলেও বাচ্চা বেরিয়ে যেতে পারে। 
শরীর বৃত্তীয় ত্রুটিজনিত কারণে অর্থাৎ মায়ের জরায়ুতে ত্রুটি (যথা সেপ্টেড ইউটেরাস, বাইকরনয়েট ইউটেরাস) থাকলে মাতৃত্ব আসার পর শিশু স্বাভাবিক বেড়ে উঠতে পারে না। এমতাবস্থায় গর্ভপাত হতে পারে। ম্যালেরিয়া বা নিউমোনিয়া জাতীয় সংক্রমণ থেকে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হতে পারে। জরায়ুতে ক্রনিক ইনফেকশনেও জরায়ুতে বাচ্চা ধরে রাখতে পারে না বা মৃত্যু হতে পারে।
অটোইউমন প্রসেস দুর্বল হলেও গর্ভপাত হতে পারে। বারবার গর্ভপাতের ফলে ইনফেকশন হয়ে বন্ধ্যাত্বও আসতে পারে। এক কথায় মা হতে হলে তিনটি জিনিস দরকার।
* ইউটেরাসকে শান্ত থাকতে হবে। * বাচ্চা থাকার মতো জায়গা ইউটেরাসে থাকতে হবে। * ইউটেরাসের মুখ বন্ধ রাখতে হবে।
আর সহজ কথায় গর্ভপাতের কারণ হলো- অস্বাভাবিক ভ্রুণ, খুঁতযুক্ত ডিম্বাণু বা শুক্রাণু, নিষেকের ফলে পরিপূর্ণ ভ্রুণ গর্ভচ্যুত হয়। ক্রোমোজোম বা জিনঘটিত কারণে যদি ভ্রুণ সঠিকভাবে গঠিত না হয় তবে, গর্ভপাত হতে পারে। প্রসূতির ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন ও থাইরক্সিন প্রভৃতি হরমোনের অভাব থাকলে গর্ভপাত হতে পারে।
ইনফেকশন : সিফিলিস, টক্সোপ্লাজমোসিস ধরনের সংক্রামক ব্যাধির কারণে বারবার গর্ভপাত ঘটে। টক্সোপ্লাজমিক রোগের জীবাণু টক্সোপ্লাজম নামক এককোষী পরজীবী প্রাণী যা অধিকাংশ সময় বিড়ালের মলের সাথে বের হয়। এ জীবাণু প্রতিকূল পরিবেশেও ছয়-সাত মাস বেঁচে থাকে। ওই সময় খাদ্য বা পানীয়ের সাথে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে টক্সোপ্লাজমা রোগের সৃষ্টি হয়। এ রোগে আক্রান্ত প্রসূতিদের বারবার গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জন্মাতে পারে অন্ধ বিকলাঙ্গ বা মৃত শিশু। অনেক সময় শিশুদের মাথায় পানি জমতে পারে তাদের বলা হয় হাইড্রোসেফালাস।
জরায়ুমুখের কার্যহীনতা
গঠিত ভ্রুণ যখন বড় হয়ে জরায়ুমুখের কাজ ভ্রুণকে ধরে রাখা। কোনো কারণে জরায়ুমুখ বড় হলে বর্ধনশীল ভ্রুণ ধরে রাখতে পারে না। ফলে গর্ভপাত হয়।
অনেক প্রসূতি ইচ্ছে করে গর্ভনাশ করেন। ফলে ভবিষ্যতে হতে পারে বন্ধ্যাত্ব। বারবার বা প্রথমবার গর্ভ নাশ করলে পরে গর্ভধারণে অসুবিধা দেখা দেয়। গর্ভ নাশ করানোর ফলে জরায়ুমুখের কার্যহীনতা বা ইনফেকশনের জন্যও গর্ভপাত হতে পারে।
অস্বাভাবিক জরায়ু 
জন্মগতভাবে অস্বাভাবিক জরায়ু বা প্রজননতন্ত্র সঠিক না হলে গর্ভধারণে অসুবিধা দেখা দেয়। ভ্রুণ জরায়ুতে সঠিকভাবে স্থাপিত না হওয়ায় গর্ভপাত ঘটে।
বিভিন্ন রোগের কারণে গর্ভপাত
অপুষ্টি, ডায়াবেটিস, নেফ্রাইটিস, উচ্চরক্তচাপ, প্রভৃতি কারণে গর্ভপাত হতে পারে। আবার মায়ের শরীরে যদি কোনোভাবে সর্বদা ইরিটেট হতে থাকে তাহলেও বাচ্চা বেরিয়ে আসতে পারে।
প্রতিকার
গর্ভপাত থেকে রেহাই বা বন্ধ্যাত্বের সঠিক চিকিৎসা হলো ওষুধ, ইনজেকশন আর অপারেশন। হরমোনাল ওষুধ ও ইনজেকশন দেয়া হয়। জরুরি হলে জরায়ুতে সূক্ষ্ম অপারেশন দরকার হয়। এর চিকিৎসাব্যয় সাধারণ মানুষের আওতার মধ্যেই আছে। যেটি প্রথমেই মনে রাখা দরকার তা হলো- মাতৃত্বকালীন সময়ে মাসিকের মতো পানি বা রক্ত বা রক্তিম পানি বের হতে থাকলে, অস্বাভাবিক ব্যথা করলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে গর্ভনষ্টের সঠিক কারণ জেনে উপযুক্ত চিকিৎসা করালে গর্ভপাত ঠেকানো সম্ভব।
গর্ভসঞ্চারের পর শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশ্রাম দরকার। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কারণে-অকারণে ওষুধ খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। হরমোনের ঘাটতি থাকলে ওষুধের মাধ্যমে তা পূরণ করা দরকার। ইনফেকশন থাকলে চিকিৎসা করা দরকার।
জন্মগতভাবে জরায়ুতে বা প্রজননতন্ত্রে ত্রুটি থাকলে অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক করে নেয়া দরকার।
চিকিৎসাশাস্ত্রে সাড়াজাগানো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হলো টেস্টটিউব বেবি। এই চিকিৎসায় প্রায় শতকরা ৩০ জনের জীবনে মাতৃত্ব আসে। তবে এই চিকিৎসাব্যবস্থা এখনো ব্যয়বহুল।
যেসব নারীর বন্ধ্যাত্ব নেই কিন্তু বারবার গর্ভপাত হয়, তার জন্য দরকার মনোবিজ্ঞানসম্মত এক চিকিৎসা। যাকে বলে টেন্ডার লভিং কেয়ার। সংক্ষেপে টিএলসি।
বাচ্চা না হওয়ার ভয় যাদের মনে ভর করে, যারা মনোবল হারিয়ে ফেলে হতাশাগ্রস্ত হন এবং ভঙ্গুর বিশ্বাস তার দেহকে গর্ভপাতের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। এমতাবস্থায় তাকে প্রতিদিন মনোবল জুগিয়ে মা হওয়ার স্বপ্ন দেখান, তার মধ্যে সন্তান হওয়ার বিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলুন। এ বিশ্বাস তার দেহকে গর্ভপাত প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখবে। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে প্রার্থনা। পরম করুণাময়ের কাছে উপযুক্ত প্রার্থনাই কাঙ্ক্ষিত মাতৃত্বের হাসি ফোটাবে।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates