বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন, গভর্নর হিসাবে রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার উদ্ধারের কাজকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। আর এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হারানো কনফিডেন্স ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। গতকাল রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১১তম গভর্নর ফজলে কবির। এর আগে তিনি সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
গভর্নর কার্যালয়ে সাংবাদিকদেরকে ফজলে কবির বলেন, রিজার্ভ থেকে চুরি হয়ে ফিলিপাইনে যাওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশেষ করে আইটি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জোর দেয়া হবে। আর ফিলিপাইন থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে বাংলাদেশের ২ জন কর্মকর্তা ফিলিপাইনে আছেন বলে জানান গভর্নর। প্রয়োজনে পরবর্তীতে আরো টিম পাঠানো হবে বলেও জানান তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আস্থা ফেরাতে কাজ করবেন জানিয়ে নতুন গভর্নর বলেন, রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে কনফিডেন্সের অভাব দেখা দিতে পারে। এটা যেন না আসে এবং তারা যাতে নির্ভয়ে আগের মতো কাজ করতে পারেন, সেজন্য কোয়ালিটি এবং কোয়ানটিটি (গুণগত ও সংখ্যাগত) দিক নিশ্চিত করা হবে। অগ্রাধিকার কাজের পরবর্তী পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের (ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক) সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
আগের গভর্নরের নেয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ড ও মানবিক ব্যাংকিংয়ের ধারাবাহিকতা থাকবে কি না সে প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসাবে সেগুলো যথারীতি বজায় থাকবে। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকে সংস্কার আসবে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে নবনিযুক্ত গভর্নর বলেন- সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। রিজার্ভ চুরির ঘটনা ছিল একটি সতর্ক বার্তা (ওয়েক আপ কল)। তাই এ ঘটনার পর যা কিছু করণীয় তা করা হবে। আমরা সার্বিক বিষয়কে আরো উন্নত করব। কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে সেগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার প্রচেষ্টা নেব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি তফসিলী ব্যাংকগুলোর জন্য সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নতুন গভর্নরের পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠিক নতুন পরিকল্পনা আছে তা নয়। নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি দায়িত্ব আছে। আর সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপনের মধ্যে আরো কিছু সংযোজন করা যায় কি না, আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে সেগুলো করা হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হবে বলে জানান তিনি।
রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনার পর আরও জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনায় সচেষ্ট থাকবেন জানিয়ে ফজলে কবির আরও বলেন, অর্থ চুরির ঘটনায় ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিজে কোন কমিটি করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার যেটা করেছে তার কার্যপরিধি অনেক বেশি। তাই সে কমিটির সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাকেশ আস্তানার তদন্ত বন্ধ করা হচ্ছে কিনা এবং তার নিয়োগ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান একটি প্রকল্পের আওতায় দুই বছরের জন্য আইটি গভর্নেন্স বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। যে কাজটি দেয়া হয়েছে তার মধ্যে অনেক কাজের একটি হিসাবে তিনি বিশ্বব্যাংকের চিফ সাইবার স্পেশালিস্ট হিসাবে কাজ করেছেন। ওনাকে আমাদের চলমান প্রকল্পের একজন পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে যখন যেমনটি দরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় গভর্নরের পদ থেকে গত ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন ড. আতিউর রহমান। ওইদিনই সাবেক অর্থসচিব ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবিরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দেয়ার কথা জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরে ফজলে কবিরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
নতুন গভর্নরের জীবন বৃত্তান্ত
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর ফজলে কবির বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সিনিয়র সচিব ছিলেন। ২০১২ সালের জুলাইতে তিনি অর্থ সচিবের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তিনি ১৯৮০ সালে সরকারের সিভিল সার্ভিসে বাংলাদেশ রেলওয়েতে এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন। সিভিল সার্ভিসে ৩৪ বছরের কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার ডেপুটি কমিশনার এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট ও বিসিএস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন একাডেমির ডিরেক্টর জেনারেল এবং রেল মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৮-২০১০ সাল পর্যন্ত জনতা ব্যাংক লি: এবং ২০১২-২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গভর্নর হিসেবে যোগদানের পূর্বে তিনি সোনালী ব্যাংক লিমিটেড পরিচালক পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি সমাপন শেষে ফজলে কবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ফজলে কবিরের সহধর্মিণী মাহমুদা শারমিন বেণু মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব।
No comments:
Post a Comment