দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক ছোট দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। ছোট হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই শক্তিশালী দেশটি। তাই নিজ দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি অন্য দেশ থেকে শ্রমিক এনেও নিজেদের অর্থনীতির চাকাকে এতদিন গতিশীল রেখেছে তারা। কিন্তু বর্তমানে প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিদেশি শ্রমিকদের দীর্ঘ মেয়াদে কাজে রাখতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এর ফলে বিপাকে পড়ছে বাংলাদেশিসহ বিদেশি শ্রমিকরা। বিশেষত বাংলাদেশি শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দালালদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর খুব অল্প সময়েই চাকরি হারিয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে অনেককেই।
জীবন বদলের স্বপ্ন নিয়ে ধারের টাকায় সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আসাদুল ইসলাম। এক বছরের মধ্যে তার সেই স্বপ্ন পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। ব্যবসায় মন্দার কথা বলে মালিক চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিয়েছে। অন্য কোনো কাজও আর জোটাতে পারেননি। ফলে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে ২৫ বছর বয়সী আসাদুলকে। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে সিঙ্গাপুরে যাওয়া এবং কাজের জন্য বিভিন্ন এজেন্সিকে আসাদুলের দিতে হয়েছে প্রায় দশ লাখ টাকা। পৈত্রিক কৃষি জমি আর মাছের খামার বিক্রি করেও ওই টাকার জোগাড় না হওয়ায় ব্যাংক থেকে তাকে ঋণ নিতে হয়।
সিঙ্গাপুরে আসাদুল কাজ পেয়েছিলেন একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে। সেখানে বিল্ডিং সাইটে ট্রাফিক সামলানো, এক্সক্যাভেটর চালানোর মত নানা কাজ করিয়ে তাকে দেওয়া হত দিনে ১৮ সিঙ্গাপুরি ডলার (এক হাজার টাকার সামান্য বেশি)। আর ওভারটাইম করলে ঘণ্টায় মিলত আরও ৩ ডলার (১৭৪ টাকা)। কিন্তু ডিসেম্বরে মালিক আসাদুলকে জানিয়ে দেন, তাকে আর চাকরিতে রাখা যাচ্ছে না। সিঙ্গাপুরের শ্রম মন্ত্রণালয় নতুন চাকরি খুঁজে নেওয়ার জন্য আসাদুলকে এক মাস সময় দিয়েছিল। কিন্তু আর কোনো কাজ তিনি জোটাতে পারেননি।
বাংলাদেশের আরও অনেক শ্রমিকই আসাদুলের মত এমন অস্থায়ী চাকরির ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে দেশে ফিরছেন। সিঙ্গাপুরের নির্মাণ, উৎপাদন, শিপিং এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন সেবা খাতে দরকারের সময় অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের এই ব্যবস্থা ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক হলেও বিদেশি শ্রমিকের জন্য তা দুর্ভাগ্য বয়ে আনছে। ব্যবসা যখন ভাল চলছে মালিকরা তখন অস্থায়ী ভিত্তিতে এই বিদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছেন। কিন্তু মন্দা এলেই চলছে ছাঁটাই, বাড়ছে বেকারত্ব। অর্থনীতির খারাপ সময়ে নতুন চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে গেলে বিদেশি শ্রমিকদের আর সেখানে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।
এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের কাজে অগ্রাধিকার দেয়ার সরকারি নীতি চালু হওয়ার পর থেকে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিপাকে রয়েছে প্রবাসী শ্রমিকরা। অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা সাধারণত বছর খানেকের মধ্যেই তাদের চাকরি হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু এই অল্প সময়ে তাদের পক্ষে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার খরচ তুলে লাভের মুখ দেখা সম্ভব হচ্ছে না।
সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশি কয়েকজন শ্রমিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিঙ্গাপুরে যেতে তাদের যে খরচ হয়েছে তা তাদের ২৬ থেকে ৫১ মাসের মূল বেতনের সমান। বৈধ ভিসা নিয়ে সিঙ্গাপুরে যেতে হলে একজন শ্রমিককে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। প্রথমে কন্সট্রাকশন অথোরিটির আওতায় প্রশিক্ষণ, তারপর নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর পরীক্ষা। তারপরই কেবল একজন শ্রমিক বৈধভাবে সিঙ্গাপুরে যেতে পারে।
এছাড়া প্রতিবছর ভিসা নবায়ন, কোম্পানির সাথে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোসহ নানা ধরণের প্রক্রিয়া রয়েছে। আর প্রতি বছর এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে একজন শ্রমিকের কমপক্ষে দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই চাকরি হারিয়ে ফেলায় তাদের প্রত্যেককেই বিপুল অংকের ঋণ নিয়ে দেশে ফিরতে হচ্ছে। শ্রমিকদের এই অসহায় অবস্থায় যেন না পড়তে হয় একারণে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
স্থায়ী চুক্তি সম্পন্ন না করে দেশটিতে কাজের জন্য না যাওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন অনেকে। অস্থায়ী চুক্তি ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক, কিন্তু শ্রমিকদের বিপাকে ফেলতে এ ব্যবস্থার জুড়ি নেই। ফলে ব্যাপক হারে শ্রমিকদের দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে। আর এই শ্রমিকেরা ফেরার সময় সাথে নিয়ে আসছে ঋণের বোঝা, যা পরবর্তিতে তাদের স্বাভাবিক জীবনকেও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
No comments:
Post a Comment