উত্তর কোরিয়া হুমকি দিয়েছে, তারা প্রশান্ত মহাসাগরে হাউড্রোজেন বোমার পরীক্ষা চালাতে পারে। যদি সত্যিই উত্তর কোরিয়া এই পরীক্ষা চালায় তাহলে কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালানোর ঘটনা ঘটবে। এই হুমকি ইতোমধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উত্তর কোরিয়াকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মঞ্চ জাতিসংঘে।
হুমকি মোতাবেক প্রশান্ত মহাসাগরে উত্তর কোরিয়া যদি হাইড্রোজেন বোমা ফেলে, তাহলে আমেরিকার সঙ্গে দেশটির যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর একবার যুদ্ধ বেধে গেলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার ‘যুদ্ধবাজ’ প্রেসিডেন্ট এখন চিতাবাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন, সেখান থেকে নামার সুযোগ কম। আবার ছোট্ট একটি দেশের হুমকি মুখ বুঝে মেনে নিতেও পারবেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এই অবস্থায় দুই দেশই গোপনে ও প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সামরিক প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে।
উত্তর কোরিয়া কী পারে?: উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্রের আধুনিকায়নে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাতে এই ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলোতে আঘাত হানতে পারে। ছয়টি পরমাণু অস্ত্রের এবং একটি ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, পিয়ংইয়ং খুব কাছেই পৌঁছে গেছে। তবে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ লুইস জেফরি কিছুটা কৌতুকের সুরে বলেন, উত্তর কোরিয়ার সামর্থ্য বা তারা পরমাণু অস্ত্রে কতটা সক্ষম তা বোঝা যাবে তারা যখন পরীক্ষা বা হামলা চালাবে। মার্কিন সামরিক বাহিনী ধরে নিয়েছে, উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যে সামর্থ্য অর্জন করেছে। গত জুনে এক বক্তব্যে ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডের (ইউএসপ্যাকম) অ্যাডমিরাল হ্যারি হ্যারিস বলেন, আমি জানি উত্তর কোরিয়ার সামর্থ্য নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। কিন্তু আমাদের আজকের জন্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি তার কথায় (কিম জং উন) বিশ্বাস করি। আমি তার আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে জানি।
উত্তর কোরিয়া কিভাবে করতে পারে?: সাধারণত হাইড্রোজেন বোমা ফেলা হয় বিমান থেকে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিয়ংইয়ং মিসাইল আকারে বোমা ফেলতে পারে। কারণ তারা জটিল প্রযুক্তি তৈরিতে সফলতা দেখাতে চায়। পরমাণু নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং এমআইটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর ভিপিন নারাং বলেন, পরমাণু অস্ত্র সজ্জিত মিসাইল সুযোগ বুঝে পরীক্ষা করা হতে পারে। আর এটা খুবই খারাপ হবে বিশ্বের জন্য। এটা কেবল উস্কানিই হবে না, এটা বড় ধরনের একটা ভুল সিদ্ধান্তও হবে।
তারা কী করবে?: নারাং বলেন, জাতিসংঘে উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রি খুব সতর্কতার সঙ্গে মন্তব্য করেছেন। তিনি পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার কথা বললেও তা কিম জং উনের হাতেই আছে বলে উল্লেখ করেছেন। আমার মনে হয় এটা তাদের চালাকি। কারণ তারা পরীক্ষার আগে খারাপ পরিণতি সম্পর্কে অবশ্যই চিন্তা করবে। প্রথমে তারা হয়তো ছোট মাপের পরীক্ষা চালাতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আরেকটি আন্ত:মহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইলের কথা বলা যায়। আর সত্যিই যদি বড় ধরনের কোনো পরীক্ষা চালায় তাহলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। তবে লুইস মনে করেন, রি তার দেশের বিস্তর কৌশলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই হুমকি দিয়েছেন। কারণ উত্তর কোরিয়া তার ভবিষ্যত্ বিপদের কথা চিন্তা করছে না। আমরা ১৯৬৬ সালে চীনকে দেখেছি তাদের পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে। আমরা এখন উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষার অপেক্ষায় আছি।
তারা করলে কী হবে?: ভৌগোলিক দিক থেকে উত্তর কোরিয়ার একটা গুরুত্ব আছে। তাই বোমার পরীক্ষা হলে সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর। যারা বিকিনি অ্যাটলের কাছে বাস করেন তারা এখনো হুমকির মধ্যে আছেন। কারণ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অনেকগুলো পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ফলে তারা এখনো স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে আছেন। বিস্ফোরণ মাছ তথা পানির নিচে বাস করা প্রাণীর জীবন ধ্বংস করতে পারে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে, বিশ্ব ১৯৮০ সালের পর এই ধরনের পরমাণু পরীক্ষা দেখেনি। ওই সময় চীন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় লপ নুরকে কেন্দ্র করে অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। সিটিবিটিও’র তথ্য অনুযায়ী, পরমাণু অস্ত্রের আবির্ভাবের পর দুই হাজারের বেশি পরীক্ষা চালানো হয়েছে। শতাধিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জেও যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। সেখানেও জনগণের মধ্যে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে, জন্মগত সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং থাইরয়েড সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ফ্রান্সের পলিনেসিয়ায়ও একই প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। পরীক্ষার কারণে ভূমিধস, সুনামি এবং ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে বলে সিটিবিটিও জানিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তর কোরিয়া যদি বিচ্ছিন্ন কোথাও পরীক্ষা চালায় তাহলে হয়তো মানুষের ক্ষতি কম হবে। ক্ষতির পরিমাণটা নির্ভর করছে তারা কোথায় পরীক্ষা চালাবে এবং ওই সময়ের আবহাওয়া কেমন থাকবে, জানান সেন্টার ফর ননপ্রোলিফারেশন স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক মেলিসা হ্যানহ্যাম। তিনি বলেন, এটা তো সত্য যে, পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষায় মানুষ এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা!: উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেওয়ার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীন এবং রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার ওপর অবরোধে সমর্থন দিলেও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চালানোর আহবান জানিয়েছে। চীন আগের চেয়ে উত্তর কোরিয়ার প্রতি কঠোর হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে কোরীয় উপদ্বীপে কোনো যুদ্ধ বাধলে তাতে দুই দেশ জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে অবস্থান নেবে এমনটা ভাবছেন না বিশ্লেষকরা। কোরীয় উপদ্বীপে কিংবা উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালালে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন। রাশিয়ায়ও পড়বে প্রভাব। আর রাশিয়া সুযোগ বুঝেই উত্তর কোরিয়ার পক্ষে অবস্থান নেবে। কারণ তারা সোভিয়েত ভাঙার কষ্ট এখনো ভুলতে পারেনি, আর পারবেও না বলে মনে করেন জেনেভা ভিত্তিক রাশিয়ান নিউক্লিয়ার ফোর্সেস রিসার্স প্রজেক্টের স্বাধীন বিশ্লেষক পাভেল পডভিগ। যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে তা তার বিরোধী দেশগুলো মেনে নিতে পারবে না। ফলে উত্তর কোরিয়ার হুমকিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে।
No comments:
Post a Comment