বিশ্বব্যাপী জনশক্তি রপ্তানিতে যে মন্দাবস্থা চলছে তা থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ। বিগত বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে জনশক্তি রপ্তানি কমছে। আগের তুলনায় কমে গেছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ও । আর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এর অন্যতম কারণ, বাংলাদেশের বড় তিনটি শ্রমবাজার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নেয়া বন্ধ থাকা।
এছাড়াও যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে লিবিয়া ও ইরাকেও শ্রমিক নেয়া বন্ধ রয়েছে। ওমান, বাহরাইন ও কাতারে কর্মী যাওয়া কয়েক বছর ধরে নতুন করে কোনো শ্রমবাজার তৈরি হয়নি সে দেশে। এদিকে, আফ্রিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতেও জনশক্তি রপ্তানিতে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় সফল বাংলাদেশি তৈরী পোশাক ব্যবসায়ীদের একজন এম এ বাশার। তিনি বলেন, ‘আমাদের শুধু জনশক্তি রপ্তানির দিকে চেয়ে থাকলে হবে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের অনেক সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার খাতগুলোতে এখন গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। আর এই সব খাতের রপ্তানি বাণিজ্যে আফ্রিকা একটি সম্ভাবনাময় দেশ।
সেখানে পন্যের দাম, বিশেষ করে তৈরী পোশাকের দাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে শিল্পোন্নত এই দেশটিতে, বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও, সেখানে ওষুধ রপ্তানিরও রয়েছে ব্যাপক সুযোগ।’ বাশার আরো জানান, এরইমধ্যে আমাদের দেশীয় কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি দক্ষিণ আফ্রিকায় ঔষধ রপ্তানী করছে। এছাড়াও দেশটিতে বিস্তীর্ন অনাবাদী জমি রয়েছে, যেখানে সবজি বা অন্য ফসল চাষাবাদ করে ভালো অর্থ উপর্জন করা সম্ভব আমাদের পক্ষে। তবে সেটা করতে হবে ওখানকার কোন নাগরিকের সাথে অংশীদ্বারিত্বের ভিত্তিতে।’ আর্থিকভাবে বাংলদেশীরা দেশটিতে বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা করে অনেক ভালা থাকলেও তাঁদের কিছু সমস্যাও রয়েছে। বাংলাদেশী এই ব্যবসায়ী জানান, প্রথমেই যে সমস্যার সম্মুখিন হতে হয় তা হলো ভিসার জটিলতা।
বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার কোন দূতাবাস নেই। ভারতের নয়া দিল্লিতে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস থেকে বাংলাদেশিদের ভিসা নেয়ার সুযোগ ছিলো। কিন্তু সেটা বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশীদের ভিসা নেয়ার একমাত্র জায়গা শ্রীলঙ্কা। কলম্বোতে অবস্থিত দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস থেকে ভিসা করিয়ে আনতে হয়। অবস্থানগত দূরত্ব আর জটিলতার কারণে ভিসা পেতেও প্রায় দুইমাস সময় লাগে। কিন্তু যদি শ্রীলংকায় যেয়ে নিয়ে আশা যায় তাহলে বিশ দিনের মধ্যেই করা সম্ভব হয়। তবে, শ্রীলংকা যাওয়া আসাও অনেক বেশী ব্যয়বহুল। এ কারণে, দেশটিতে অবৈধ প্রবাসীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন বাশার। সঠিক সংখ্যা না জানা গেলেও বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী, সেখানে বৈধ বা অবৈধভাবে এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি অবস্থান করছে। যারা বিভিন্ন মাধ্যমে, বছরে প্রায় সত্তর কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে। মূলত এই সব কারণে বৈধ ভাবে দেশে টাকা পাঠানোও সম্ভব হয় না। আফ্রিকার সব স্থানে না হলেও দেশটির কিছু কিছু জায়গায় নিরাপত্তার সমস্যা রয়েছে।
এ বিশয়ে এম এ বাশার জানান, দুর্বৃত্ত বা ছিনতাইকারীদের হামলায় বাংলাদেশিদের প্রাণ হারানোর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সেজন্য দেশটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও অধিকার রক্ষায় দূতাবাসের ভূমিকা সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তাই দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ দূতাবাসকে এ বিষয়ে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দেন। এর ফলে, আরো কম খরচে দেশটিতে দক্ষ জনবল রপ্তানি করাও সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী।’ তবে, বাশার জানান প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছু প্রতিকূলতা ও নিরাপত্তার সমস্যা থাকলেও, দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম শহর কেপটাউনের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন।
শহরটিতে বাংলাদেশিরা অনেক নিরাপদে ব্যবসা ও বসবাস করছে। কেপটাউনে বেশিরভাগ প্রবাসী মুদি দোকান,ফলের দোকান ও কাপড়ের ব্যবসায় জড়িত। এছাড়া, ব্যবসা-বানিজ্য করার ক্ষেত্রে দেশটির আইনও অনেক সহজ। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার সেখানে বিনিয়োগ বা ব্যবসা করার জন্য প্রবাসীদের দুই বছরের বিজনেস ভিসা দেয়। এভাবে বছরের পর বছর সেখানে ব্যবসা করছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দক্ষিণ আফ্রিকায় স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য অবশ্যই সেখানে কাজ করার বৈধ কাগজপত্র দেখাতে হবে। তবে এটি অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া বলে জানান তিনি। যারা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেয়ে যায় তাদের পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরিসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয় দেশটির সরকার।’
বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এম.এ বাসার আরো বলেন, ‘কেপটাউনের সবচেয়ে বড় পোশাক আমদানী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করছি আমি। ‘একারমেন্স’ নামের এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় তেরশ’র মত স্টোর রয়েছে। তারা সব সময় বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। তাছাড়া আফ্রিকায় ব্যবসা করা অনেক সহজ হয়েছে আমাদের জন্য। বিশেষ করে পোশাক রপ্তানীর ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগীতা এই ব্যবসার এই পথকে অনেক সহজ করেছে ।’ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আরো বেশি রেমিটেন্স না আসার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের বৈধ উপায়ে দেশে টাকা পাঠাতে না পারা একটি বড় সমস্যা এ ক্ষেত্রে।
অবৈধ উপায়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর ফলে প্রচুর রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। আবার হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গিয়েও অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তাই, বৈধ উপায়ে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা চালু করতে, দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহবান জানান এই ব্যবসায়ী। আর এটা চালু হলে,দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের পরিমাণ উল্লেখেযোগ্য হারে বাড়বে বলে মনে করেন, তৈরী পোশাক ব্যবসায়ী এম এ বাশার।
No comments:
Post a Comment