দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যাঞ্চলের একটি অনুন্নত দেশ প্যারাগুয়ে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও বলিভিয়া পরিবেষ্টিত দেশটি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ হলেও আয়-রোজগারের দিক দিয়ে সেখানে ভালো আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
প্রায় ১ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্যারাগুয়েতে এখন প্রায় দুই হাজারের মত বাংলাদেশির বসবাস। আর্জেন্টিনার সীমান্তবর্তী ‘আসুনসিয়ন’ নগরী এই দেশটির রাজধানী। এখানে মাত্র ৩০-৩৫ জন বাংলাদেশির বসবাস। তবে রাজধানী থেকে ৫শ’ কিলোমিটার দূরে দেশের অপর প্রান্তে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সীমান্তঘেঁষা শহর সিউদাদ দেল এস্তে বসবাস করেন প্রায় ৮শ’ বাংলাদেশি। প্যারাগুয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ‘সিউদাদ দেল এস্তে’ থেকে ২শ’ কিলোমিটার উত্তরে ‘সালতো দেল গুয়াইরা’ এবং ব্রাজিলীয় সীমান্ত ঘেঁষেই আরো উত্তরে ‘পেদ্রো খুয়ান কাবাল্লেরো’। উভয় শহরেই প্রায় সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ বাংলাদেশির বাস।
আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি ব্রাজিলকে ঘিরে বছরজুড়ে জমজমাট ব্যবসার সুবাদে সীমান্তবর্তী এই তিনটি শহরেই মূলত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি কমিউনিটি। ২৫-৩০ বছর আগে থেকেই দেশটিতে বাংলাদেশিদের বসবাস, তবে সড়ক পথে আমেরিকা-কানাডা যাবার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশিরা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-মেক্সিকোসহ লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতো প্যারাগুয়েকেও বছরের পর বছর ব্যবহার করে এসেছে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজারে হাজারে গিয়েছেনও ‘কথিত’ স্বপ্নের দেশে।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ প্যারাগুয়ে বাংলাদেশের তুলনায় বিভিন্ন দিক দিয়ে খুব বেশি উন্নত না হলেও এখানে বসবাসরত হাজার দুয়েক বাংলাদেশি সব মিলিয়ে অনেক ভালো আছেন। মাস শেষে তারা গড়ে দুই হাজার ইউএস ডলার থেকে পাঁচ হাজার ডলারও আয় করছেন। ‘সিউদাদ দেল এস্তে’, ‘সালতো দেল গুয়াইরা’ ও ‘পেদ্রো খুয়ান কাবাল্লেরো’ তিনটি শহরের অধিকাংশ বাংলাদেশিরা একই ধরণের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
লেবানিজ ও ভারতীয় পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে তাদের হোল-সেলে কিনতে হয় বিভিন্ন কাপড়-চোপড় ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, যেমন- পিসি, মোবাইল, ক্যমেরা সহ রকমারি পণ্য । চাহিদা মোতাবেক তারা এসব সাপ্লাই দিয়ে থাকেন বিভিন্ন ছোট ছোট দোকানগুলোতে, যেতে হয় অনেকটা ডোর টু ডোর। মালামাল নিয়ে দূর দূরান্তের বিভিন্ন শহরেও যেতে হয় অনেককে। স্বাভাবিক পরিশ্রমেই মাসের শেষে অন্তত দুই হাজার ডলার আয়। সারা বছরই ব্যবসা হয়, তবে আয়-রোজগার প্রতি মাসে সমান যায় না। চোখ-কান খোলা রেখে বাড়তি পরিশ্রম করে গড়ে হাজার পাঁচেক ডলারও আয় করছেন অনেকেই।
‘সিউদাদ দেল এস্তে’ শহরে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে দোকান নিয়েও ব্যবসা করছেন। ব্রাজিল সীমান্ত জুড়ে বছরব্যাপী যে রমরমা ব্যবসা, তার শতকরা ৯০ ভাগ ক্রেতাই হচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান তথা ব্রাজিল থেকে আসা লোকজন। যে জিনিস ব্রাজিলে ১০ ডলার, ঘরের কাছের প্যারাগুয়ে থেকে তা কেনা যাচ্ছে মাত্র ২-৪ ডলারে। ‘লিভিং কস্ট’ অর্থ্যাৎ জীবন যাত্রার ব্যয় ব্রাজিলের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ প্যারাগুয়েতে। সবাই শুধু কেনাকাটা করতেই সকাল-সন্ধ্যা ব্রাজিল থেকে প্যারাগুয়েতে যায় না। রাতে থাকে ব্রাজিলে আর সারাদিন ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্যারাগুয়েতে এমন লোকজনও আছে হাজার হাজার।
বলা হয়ে থাকে, কেনাকাটা ও ব্যবসার জন্য ব্রাজিল থেকে লোকজন যদি এক দিন সীমান্ত পাড়ি না দেয়, তবে সেদিন প্যারাগুয়ে অচল। অভিবাসী হিসেবে কোন রকমে দেশটিতে ঢুকতে পারলে খুব কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে বৈধ হওয়া যায় সেখানে। হাজার-পনের’শ ডলার খরচায় চুক্তিভিত্তিক বিবাহের জন্য মেয়ে পাওয়া অনেকটাই পানির মতো সহজ প্যারাগুয়েতে।
কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ ছাড়াও ভিন্ন পথে বছরের যেকোনো সময় বৈধতা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে খরচ পড়ে ৮শ’ থেকে ১২শ’ ডলার। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সর্বোচ্চ দুই হাজার ডলার খরচ করে বৈধ হওয়া যায়। প্রতিবেশী ব্রাজিলের মতো বড় পরিসরে না হলেও বাংলাদেশি গার্মেন্টস সামগ্রী চিলি হয়ে সীমিত পরিসরে যাচ্ছে দেশটিতে। প্যারাগুয়ের সয়াবিন তেলের মান অনেক ভালো, আর সাশ্রয়ী দামেও পাওয়া যেতে পারে বাংলাদেশের জন্য। সব মিলিযে বলা যায় যে, পুরো লাতিন আমেরিকায় আগামী দিনে ব্যাপক হারে বাংলাদেশিদের সমাগম ঘটবে। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই প্যারাগুয়েতেও দিন দিন বাড়বে বাংলাদেশিদের সংখ্যা।
No comments:
Post a Comment