একটা সময় সৌদি আরব ছিল বাংলাদেশিদের অন্যতম কাঙ্খিতগন্তব্য। চাকরি, ব্যবসা সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশিরা সেখানে অনেক ভালো ছিল। তবে সেই সুদিন আর এখন নেই। নানা ধরণের সমস্যা নিয়ে এখন টিকে থাকতে হচ্ছে প্রবাসীদের। সৌদি অর্থনীতিতে দীর্ঘ দিন ধরে মন্দাভাব চলছে। এক্ষেত্রে তেলের দাম পড়ে যাওয়াও এর অন্যতম একটি কারণ। এক ব্যারেল তেলের দাম যেখানে ছিল ১৪০ ডলার তা এখন মাত্র ৫৫ ডলারে নেমেছে।
তাছাড়া ইয়েমেন এবং সিরিয়ার যুদ্ধে সৌদি আরব জড়িয়ে পড়াও অর্থনৈতিক মন্দার অন্যতম আরেকটি কারণ। সৌদিতে কনস্ট্রাকশনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রবাসী ব্যবসায়ী শেখ আব্দুল মান্নান। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি আছেন সৌদিতে । তিনি বলেন, ‘ এভাবে খুব বেশিদিন সৌদিতে ব্যবসা বাণিজ্য করে টিকে থাকা যাবে বলে আমার মনে হয় না। আমার জানা মতে অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা এখন বাহরাইনের মত আশেপাশের অনেক দেশে চলে যাচ্ছেন।’
রিয়াদ প্রবাসী ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা হয় । তিনি জানান, ‘সৌদিতে আমার শুরু অনেক কষ্টের ছিল। আমি চাকরি নিয়েই প্রথমে সৌদি যাই। সেটা নব্বইয়ের দশকের কথা। এখন আমি সৌদিতে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর জন্য আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। সৌদিতে প্রবাসীদের ব্যবসার ক্ষেত্রে অবশ্য সেই স্বর্ণ যুগ এখন আর নেই। কেননা আগে যে লেবার কার্ড ১০০ রিয়াল ছিল এখন তা বেড়ে কয়েকগুন হয়েছে। সত্যি বলতে কী সৌদি সরকার প্রবাসীদের আটকে ফেলেছে। আমাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো এখন খুবই কঠিন।’ আরেকটি বিষয় হলো সৌদিতে গৃহকর্মী হিসেবে যারা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হতে হচ্ছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি আরবে বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন নিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। এ বিষয়ে শেখ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘সৌদিতে নারী গৃহকর্মীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অহরহ। তারা ঘরে কাজ করে ফলে এক ধরণের বন্দী জীবন যাপন করতে হয় তাদের। অনেক সময় অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন ও কাজ না পাওয়া, দুর্ব্যবহার বা নির্যাতনের কারণে গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে দূতাবাসের সেফ হোমে চলে আসেন নারী গৃহকর্মীরা।
তাছাড়া বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের নারী কর্মীরা ঝুঁকিতে পড়ছেন। এসব কারণের মধ্যে যেমন ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ-আতঙ্ক, গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বেতন না দেওয়া, ফোন কেড়ে নেওয়া, নির্যাতনের পর পালিয়ে গেলে থানায় চুরি ও নাশকতার মামলা দেওয়া, নির্যাতনের পর পালিয়ে পুলিশের আশ্রয়ে গেলে আবার আগের নিয়োগকর্তার কাছে ফেরত পাঠানো। এছাড়াও অসুস্থ হলে চিকিৎসা না করা, বেশি অসুস্থ হলে রাস্তা কিংবা দূতাবাসের সামনে ফেলে যাওয়া এবং দূতাবাসকে না জানিয়ে ক্রীতদাসের মতো এক এজেন্সি থেকে অন্য এজেন্সিতে বিক্রি করে দেওয়ার মত ঘটনাও এখানে ঘটে থাকে।
এ অবস্থায় সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করারও যেন কোন সুযোগ নেই এই দেশটায়।’ আর এই সব কিছুর পেছনে রয়েছে সৌদিদের অর্থ আয়ের একটি স্পৃহাও। সৌদিদের মানবিক আচরণের গল্পগুলোও এখন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে প্রবাসী ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, সৌদিতে এখন অবৈধ অভিবাসীদের নামে ধর পাকড় চলছে। যারা বৈধভাবে আছে সেই সব প্রবাসীরাও যখন ভালো কাজ পাচ্ছে না। সেই সময় সৌদি সরকার নিয়মিত ভিসাও দিচ্ছে। নতুন করে বাংলাদেশিরা আসছে সৌদিতে। মজার ব্যাপার হলো বৈধভাবে তারা এসে ফিরে যাচ্ছে অবৈধ হয়ে। আবার কেউ কেউ আসছে নতুন নতুন ভাবে।
এই আসা যাওয়ার মধ্যে সর্বস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশিরা। কিন্তু সৌদিদের ঠিকই অর্থ আসছে। এটা সৌদির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের একটি উপায় ছাড়া আর কিছু না। অর্থের এই পথটি তারা এখন ভালোই বুঝে।’ আর এ ক্ষেত্রে নতুন করে যারা যাচ্ছে তারা বেশি বিপদে পড়ছে সৌদিতে। কাজ নেই কিন্তু বাংলাদেশিরা আসছে। নিঃস্ব আর সর্বস্ব হারানো বাংলাদেশিদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
No comments:
Post a Comment