Social Icons

Friday, December 1, 2017

যুগ পরিবর্তন ও মহানবী (সা.)-এর জীবন

হিজরি বছরের হিসাবে রবিউল আউয়াল মাস শুরু হয়ে গেছে। ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সা.)-এর জন্মদিবস তথা ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী। দিবসটির প্রধান চরিত্র বা প্রধান উপলক্ষ হলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
পৃথিবীতে জনসংখ্যার দিক থেকে প্রধান ধর্ম হল খ্রিস্টধর্ম বা ক্রিসচিয়ানিটি; দ্বিতীয় প্রধান ধর্ম হল ইসলাম। বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত এবং গতিশীল ধর্ম ইসলাম। দ্বীন ইসলামের শুরু হয় কলেমায়ে তৈয়বা দিয়ে। যার অর্থ আল্লাহ ব্যতীত কোনো মা’বুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত রাসূল।

গোটা পৃথিবীর মুসলমানগণকে পবিত্র কোরআনের ভাষায় মিল্লাত-এ-ইবরাহিম বলা হয়। কিন্তু দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে আমাদের নবী তথা বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে।

অতএব, আমরা যারা নিজেদের দ্বীন ইসলামের অনুসারি বলে ঘোষণা করি, আমাদের জন্য আবশ্যক আমরা যেন নবী (সা.) সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করি। আমরা তাঁর উম্মত, অতএব আমাদের নবীকে জানা জরুরি। এই জানা-জানির বিষয়টি কোনোমতেই শুধু আলেম-ওলামা এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের বিষয় নয়। মুসলিম জাতির দায়িত্ব নবীজী (সা.)কে জানা। জানতে হলে পড়তে হবে। জানার জন্য বিশেষ কোনো সময় নেই। জ্ঞান অর্জন সর্বাবস্থায় সম্ভব। কিন্তু কোনো কোনো সময় উপলক্ষটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু রবিউল আউয়াল মাস এসেই গেছে, তাই এই সময়টিতে মহানবী (সা.)-এর জীবনকে জানার জন্য, তার জীবন থেকে শিক্ষা আহরণ করার জন্য, তাঁর শিক্ষাগুলোকে প্রচার করার জন্য, রবিউল আউয়াল মাস একটি উপলক্ষ হতেই পারে।

মহানবী (সা.)-এর জীবনী নিয়ে বহু পুস্তক লেখক বা কলাম লেখক বা প্রবন্ধকারকেই দেখেছি একটি পুস্তকের রেফারেন্স দিতে। পুস্তকটির নাম ‘দি হান্ড্রেড : এ র‌্যাংকিং অফ দি মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পারসনস ইন হিস্ট্রি’। এই বইয়ের লেখক পাশ্চাত্যের একজন অমুসলিম পণ্ডিত যার নাম মাইকেল এইচ হার্ট। মাইকেল হার্ট পৃথিবীর ইতিহাসে বা সভ্যতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বা সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী একশ’জন ব্যক্তিত্বের তালিকা ও জীবনী প্রকাশ করেছেন তার বইয়ে।

মাইকেল হার্টের মতে এবং তার বইয়ে প্রকাশিত তালিকা মোতাবেক, এই একশ’জনের মধ্যে ক্রমিক নম্বর ১ হচ্ছেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), তথা মাইকেল হার্টের ভাষায় মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন মানবসভ্যতার ওপরে, মানব ইতিহাসের ওপরে- সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব।

অতএব তিনিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। মাইকেল হার্ট জানতেন, তার এই বিবেচনা বা সিদ্ধান্ত প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী নিয়ে যে অধ্যায় তার পুস্তকের শুরুতেই আছে, সেই অধ্যায়ের শুরুতেই এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখাটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু এর মর্ম ব্যাপক।

মাইকেল হার্ট লিখেছেন, ‘ইতিহাসে মুহাম্মদই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় অঙ্গনে এবং জাগতিক অঙ্গনে তথা উভয় ক্ষেত্রে চরমভাবে সফল হয়েছিলেন। বাকি ৯৯ জনের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো না কোনো সভ্যতার কেন্দ্রে বা জনপদে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং উৎসাহব্যঞ্জক বা জ্ঞানবান্ধব পরিবেশে বড় হয়েছেন। কিন্তু ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে যখন মুহাম্মদ আরব উপদ্বীপের মক্কা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন চতুর্দিকের জনপদগুলো, তাদের লেখাপড়ার স্তর এবং তাদের ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার স্তর তৎকালীন পৃথিবীর পরিচিত মানদণ্ডে নিন্মস্তরে ছিল। এমন নিন্মস্তরে থেকেও তিনি একটি নতুন চিন্তা-চেতনা, নতুন সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।’

আমি মাইকেল হার্টের সিদ্ধান্তের কারণেই মুহাম্মদ (সা.)কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলব না, বরং আমার নিজের বিশ্লেষণ ও নিজের বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তেই আমি তাঁকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলব। পাঠকের প্রতিও বিনীত নিবেদন, আসুন আমরা জানি এবং নিজেরাই মূল্যায়ন করি তাঁকে।

ভাঙন সৃষ্টি করা বা ভেঙে দেয়া সহজ, জোড়া লাগানো বা গঠন করা কঠিন। সমালোচনা করা খুব সহজ, সমালোচনার উত্তর দেয়া কঠিন। সমালোচনা করা খুব সহজ কেন? এই জন্যই সহজ যে, গুজবের ওপর ভিত্তি করে, কান-কথার ওপর ভিত্তি করে, চটকদার সংবাদ পড়ে, ভিত্তিহীন রচনা পড়ে যেই হালকা জ্ঞান অর্জন করা হয় সেই হালকা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই সমালোচনা করা যায়।

কিন্তু সমালোচনার উত্তর দিতে গেলে, গভীর এবং ব্যাপক লেখাপড়া করতে হবে, সুপ্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতের সুপরিচিত লেখা পড়তে হবে এবং যে কোনো তথ্যের বা মতামতের গোড়ায় যেতে হবে। আল্লাহতায়ালা, কোরআনের পাঠক এবং বিশ্বাসীর সামনে নবীজী (সা.)-এর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এভাবে : ‘তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছেন। তোমাদের যা উদ্বিগ্ন করে সেগুলো তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মোমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র এবং পরম দয়ালু।’

অনুসন্ধিৎসু বা অনুসন্ধানী মনসম্পন্ন যে কোনো সচেতন মুসলমানেরই জানতে চাওয়ার কথা, স্বাভাবিক যুক্তিতে, কী কারণে বা কী যুক্তিতে বা কী প্রেক্ষাপটে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধু সম্বন্ধে এসব বাক্য উপস্থাপন করেছিলেন। সম্মানিত পাঠক খেয়াল করুন, আমি পূর্ববর্তী বাক্যে লিখেছি দুটি শব্দ : স্বাভাবিক যুক্তিতে। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্বে মুসলমানদের সামনে স্বাভাবিক যুক্তিগুলোকে অস্বভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সহনীয় বিষয়গুলোকে অসহনীয় করে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

সুন্দর সুস্মিত বিষয়গুলোকে অসুন্দর ও কঠোর করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কে করছে? পাশ্চাত্য বিশ্ব; বন্ধুবেশী শত্রুগণ এবং অল্প বিদ্যায় আপ্লুত অহঙ্কারী মুসলমানগণ। আমি নিজে প্রার্থনা করি আল্লাহতায়ালা যেন আমাকে বা আমাদের সঠিক উপস্থাপনার তৌফিক দেন। এ সমালোচনার বা এ অযৌক্তিকতার সঠিক উত্তর দিতে গেলেই আমাদের পড়তে হবে, জানতে হবে। জানলে আমরা নৈতিকতার শিকড় খুঁজে পাব। মানবতাবাদের শিকড় খুঁজে পাব। অর্থনৈতিক সাম্যের শিকড় খুঁজে পাব।

সে জন্যই এই কলামের পাঠকদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, আমরা যেন দ্বীন ইসলাম সম্বন্ধে এবং মহানবী (সা.) সম্বন্ধে মৌলিকভাবে জানতে চেষ্টা করি। এ কথাটি সাম্প্রতিক এক দশকের ফেসবুকের রচনাবলীর ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনই দেড় হাজার বছরের পুরনো দ্বীন ইসলামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুঃখজনক বাস্তবতা হল, শুধু আজকে বলে নয়, গতকাল এবং গত পরশু তথা গত দশক বা গত শতাব্দী বা তার আগেও একটি প্রবণতা যেমন ছিল, সেই একই প্রবণতা আজও আছে। প্রবণতাটা কী? প্রবণতা হল, সাধারণভাবে মুসলিম তরুণ-তরুণীদের লেখাপড়া থেকে দূরে থাকা, গবেষণা থেকে দূরে থাকা, কানকথা ও গুজবের ওপর নির্ভর করা, দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে লেখাপড়াকে পশ্চাৎমুখিতা মনে করা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী পড়াকে অনুৎপাদনশীল শ্রম মনে করা। এ প্রবণতার কারণে, মুসলমান সমাজের তরুণ-তরুণীরা, সাধারণভাবে, অর্থাৎ ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণগণ, আমরা যে কোনো বিষয়ের মৌলিক জ্ঞান থেকে যোজন যোজন দূরে পড়ে আছি।

আমি ব্যক্তিগত জীবন থেকে একটি উদাহরণ দিই। ছোটকালে এসএসসি বা এইচএসসি লেভেলে ছিলাম কলা বিভাগের (বা মানবিক বিভাগের) ছাত্র। স্নাতক করেছি কলা বিভাগে অর্থাৎ বিএ। মাস্টার্স করেছি কলা এবং বিজ্ঞানের মাঝামাঝি তবে কলার দিকে প্রাধান্য বেশি; মাস্টার্স ইন ডিফেন্স স্টাডিজ। আমি কোমরে ব্যথা কেন হয়, গলব্লাডারে পাথর কেন হয়, চোখে কেন ছানি পড়ে ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে কূল পাব না।

তাই জ্ঞানী ডাক্তারদের সিদ্ধান্তই মেনে নিই। কিন্তু পৃথিবীর উষ্ণতা কেন বেড়ে যাচ্ছে সেটি সম্বন্ধে কিছু না কিছু জানতে চেষ্টা করি কারণ, পুরোটা বুঝব না, কিন্তু কিছুটা বুঝব। বাংলাদেশ থেকে টাকা কীভাবে পাচার হয়, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান নাম দিয়ে কীভাবে বড় বড় মাত্রার টাকা চুরি করা হয় ইত্যাদি চিন্তা করলে আমি হয়রান হই না, তাই চিন্তা করি; কারণ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এটা আমাকে বুঝতেই হবে। উদাহরণ শেষ; এখন মৌলিক প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তথা নবীজীর জীবনী বা তাঁর জীবনের কর্ম সম্বন্ধে জানার জন্য সুযোগের কোনো অভাব নেই। বইপুস্তকের অভাব নেই। যে ভাষায় মানুষের ইচ্ছা সেই ভাষাতেই যথেষ্ট বইপুস্তক এবং লেখাপড়ার উপাদান আছে। গত পাঁচ ছয় দশকে, বাংলা ভাষায় অনেক জ্ঞানী-গুণীর কলামে মহানবী (সা.)-এর জীবনী লেখা হয়েছে বা তাঁর জীবনে মূল্যায়নমূলক গ্রন্থ লেখা হয়েছে বা অন্যান্য ভাষা থেকে মূল্যবান পুস্তক বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম যুগপৎ প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হল ইবনে হিশাম লিখিত ‘সিরাত’। গ্রন্থটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

অতি সম্প্রতি বাংলা ভাষায়ও এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ‘মহানবীর জীবন চরিত’ নামক গ্রন্থটিও একটি অনুবাদ; আলোচ্য বইটি মিসরের প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক ডক্টর মুহাম্মদ হোসাইন হায়কলের আরবি ভাষায় প্রণীত ‘হায়াতে মুহাম্মদ (সা.)’ নামক গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ; অনুবাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আবদুল আউয়াল। সঙ্গীতশিল্পী মোস্তফা জামান আব্বাসী লিখেছেন জীবনী গ্রন্থ ‘মুহাম্মদ-এর নাম’ এখনও অতি জনপ্রিয় এসব গ্রন্থ। ইন্টারনেট মানুষের জ্ঞান অর্জনের প্রশস্ত রাস্তা খুলে দিয়েছে।

গুগলে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের কোনো ঘটনা নিয়ে সার্চ দিলে বা জীবনী গ্রন্থগুলো তালিকার প্রসঙ্গে সার্চ দিলে, বিশাল তথ্য ভাণ্ডার উপস্থিত হবে। এখানে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে; কেননা ইন্টারনেটে প্রাপ্ত লেখাগুলোর লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাবধান থাকতে হবে তরুণদের।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates