Social Icons

Monday, February 4, 2019

ই-পাসপোর্টে নতুন সংকট: দশ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণে গড়িমসি

ই-পাসপোর্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে জার্মানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ সাত মাস পর আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ নিয়ে এক অভিনব জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী জার্মান কোম্পানি দশ আঙুলের ছাপ নিলেও পাসপোর্টের ইলেকট্রনিক চিপে মাত্র দুটি আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করতে চায়।
কিন্তু ভবিষ্যতে জালিয়াতির আশঙ্কায় এ প্রস্তাবে কোনোমতেই রাজি হচ্ছে না পাসপোর্ট অধিদফতর। তারা দশ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের ব্যাপারে অনড়।
সূত্র বলছে, এ ছাড়াও যথাযথ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য, পাসপোর্ট বইয়ের মানসহ আরও বেশ কয়েকটি বিষয়ে জার্মানির সঙ্গে মতবিরোধ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। এ নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে একাধিক চিঠি চালাচালির পরও কোনো সমাধান আসেনি।
ফলে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা এই মেগা প্রকল্পের কার্যক্রম এখন অনেকটাই থমকে গেছে। এ অবস্থায় বহুল প্রতীক্ষিত ই-পাসপোর্ট বই যথাসময়ে নাগরিকদের হাতে আসার সম্ভাবনাও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী গত বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট বই সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় চলতি বছরের শেষেও ই-পাসপোর্ট হাতে আসার ক্ষেত্রে ধোঁয়াশা রয়েছে। যদি ২০১৯ সালেও ই-পাসপোর্ট বিতরণের কাজ শুরু করা না যায় তবে পাসপোর্ট অধিদফতরকে এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের সবকিছুই উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলা আছে। তাই উভয় পক্ষেরই চুক্তির বাইরে গিয়ে ১০ আঙুলের জায়গায় ২ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ বা অন্যকিছু করার সুযোগ নেই। চুক্তিতে যেভাবে বলা আছে, সেভাবেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।
প্রসঙ্গত, জার্মান সরকারের সঙ্গে জিটুজি চুক্তির আওতায় ই-পাসপোর্ট প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট প্রবর্তন ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা’। ১৯ জুলাই জার্মানি ও বাংলাদেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়। প্রায় ৩ হাজার পৃষ্ঠার বিশাল চুক্তিপত্রে খুঁটিনাটি বিষয়ও বিশদভাবে বলা আছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এখন চুক্তির অনেক কিছুই পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে রাজি হচ্ছে না জার্মান কোম্পানি ভেরিডোজ।
সূত্র বলছে, চুক্তি অনুযায়ী ই-পাসপোর্টে সংযুক্ত ইলেকট্রনিক চিপে একজন ব্যক্তির পুরো মুখমণ্ডল, চোখের মণি বা আইরিশ, দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ, ডিজিটাল স্বাক্ষর ও নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত ব্যক্তিগত তথ্য রাখার কথা। কিন্তু ভেরিডোজ এখন বলছে, সব তথ্য নেয়া হলেও চিপে সংরক্ষণ করা হবে এর আংশিক।
যেমন- ১০ আঙুলের ছাপ নেয়া হলেও ইলেকট্রনিক চিপে সংরক্ষিত রাখা হবে মাত্র ২টি আঙুলের ছাপ। ভেরিডোজের এই উদ্যোগে আপত্তি তুলেছে পাসপোর্ট অধিদফতর। কারণ মাত্র দুটি আঙুলের ছাপ রাখার ফলে পাসপোর্ট জালিয়াতির পথ অনেকটাই খোলা থাকবে। ফলে আঙুলের ছাপ জালিয়াতি করে একাধিক পাসপোর্ট নিতে জালিয়াত চক্রের খুব বেশি অসুবিধা হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অধিদফতরের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আঙুলের ছাপ কমবেশি সংরক্ষণের মূলে খরচ বাঁচানোর কৌশল রয়েছে। কারণ ১০ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের জন্য উন্নত তথ্য ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ইলেকট্রনিক চিপ লাগাবে, যা মাত্র দুটি আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের জন্য দারকার হবে না।
পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে- যদি চিপে সংরক্ষণ করা না হয় তবে ১০ আঙুলের ছাপ নিয়ে কী লাভ। শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীর ছাপ সংরক্ষণ করা হলে অন্য আঙুলের ছাপ দিয়ে পাসপোর্ট জালিয়াতির পথ খোলাই থাকবে।
সূত্র বলছে, এমন অবস্থায় দাফতরিক একাধিক চিঠি চালাচালির পর বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ডিসেম্বরে জার্মানি সফর করে। পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মাসুদ রেজওয়ানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি ১১ ডিসেম্বর জার্মানির এথেন্সে ভেরিডোজের সঙ্গে মিটিংয়ে বসে। সেখানে উভয় দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার একপর্যায়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন পাসপোর্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, পাসপোর্ট বুকলেটের নমুনা দেখানোর সময় ভেরিডোজ নিুমানের বুকলেট উপস্থাপন করে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের সময় বেশ দূর থেকে কভার পেজ দেখানো হয়, যাতে বুকলেটের থ্রিডি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের ঘাটতি চোখে না পড়ে।
কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা খোলা চোখেই এই ঘাটতি ধরে ফেলেন। এরপর উপস্থাপিত বুকটেলে নমুনা ল্যাবটেস্টে পাঠানো হলে ঘাটতির বিষয়টি পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যায়। তখন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, এ ধরনের নিুমানের বুকলেট কিছুতেই গ্রহণ করা হবে না।
একপর্যায়ে ভেরিডোজের প্রতিনিধিরা বুকলেটের থ্রিডি বৈশিষ্ট্যের ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করে তা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পর ১০ আঙুলের ছাপের জায়গায় ২ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে বৈঠকে কোনো ঐকমত্য হয়নি।
এরপর ২৮ জানুয়ারি ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান খান চুক্তি অনুযায়ী ১০টি আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের তাগাদা দিয়ে ভেরিডোজকে চিঠি দেন। পরদিন ২৯ জানুয়ারি এক চিঠিতে ভেরিডোজ জানায়, বিশ্বের কোথাও ই-পাসপোর্টে ১০ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করা হয় না। উন্নত দেশের মধ্যে জার্মানিতে শুধু মুখমণ্ডল ও দুই আঙুলের ছাপ এবং অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও যুক্তরাজ্যে ই-পাসপোর্টের ইলেকট্রনিক চিপে শুধু মুখমণ্ডলের ছবি থাকে।
তবে ভেরিডোজের এই উদাহরণ মেনে নিচ্ছে না বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মাসুদ রেজওয়ান যুগান্তরকে বলেন, পৃথিবির কোথাও ১০ আঙুলের ছাপ রাখা হয় না, এ কথাটি সঠিক নয়।
সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি দেশের ই-পাসপোর্টে ১০ আঙুলের ছাপই রয়েছে। উন্নত দেশে পাসপোর্ট জালিয়াতির ধরন আর বাংলাদেশে জালিয়াতির ধরনও এক নয়। তাছাড়া চুক্তিতে ১০ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের কথা বলা আছে। এখন দুটি আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের কথা বলা চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
সূত্র বলছে, আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ জটিলতা ছাড়াও ই-পাসপোর্ট প্রকল্পে আরও বেশকিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। যেমন- চলতি বছরের মে-জুনের মধ্যে প্রকল্পের প্রিন্টিং মেশিন চলে আসার কথা। কিন্তু এখনও এ সংক্রান্ত এলসি খোলাই হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নির্ধারিত সময়ে প্রিন্টিং মেশিন আসছে না।
এছাড়া বিদ্যমান মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে ই-পাসপোর্টের তথ্য সংযুক্তকরণের কাজও এগোয়নি। অথচ এই সংযুক্তকরণ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মেশিন রিডেবল প্রকল্পের তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের তথ্যভাণ্ডারের সংযোগ না হলে একজন ব্যক্তি একাধিক পাসপোর্ট নিতে পারবে। মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট থাকার পরও নতুন আরেকটি ই-পাসপোর্ট নেয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণের কাজ করছে মালয়েশিয়ার আইরিশ কোম্পানি। আর ই-পাসপোর্ট প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে জার্মানির ভেরিডোজ। দুই প্রকল্পের তথ্যভাণ্ডার সংযুক্তির জন্য আইরিশ ও ভেরিডোজের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক একটি চুক্তি স্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কিন্তু এ চুক্তি প্রক্রিয়ার কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়নি ভেরিডোজ। তছাড়া চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের মোট অর্থের ১৫ শতাংশ এরই মধ্যে অগ্রিম হিসাবে ছাড় করা হয়েছে। অথচ মূল কোম্পানি তার সহযোগী কোম্পানিগুলোকে একটি টাকাও দিচ্ছে না। এতে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের নির্ধারিত সময় এরই মধ্যে একদফা পিছিয়ে গেছে। নতুন যে তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটিও ঠিক থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। যেমন- গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ই-পাসপোর্টের একটি নমুনা বুকলেট সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু এখন তারিখ পিছিয়ে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ মার্চ। কিন্তু বিদ্যমান জটিলতা কাটিয়ে মাত্র এক মাস পরই মার্চে বুকলেট সরবরাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
একইভাবে প্রথম ব্যাচের বুকলেট সরবরাহের নতুন তারিখ ধরা হয়েছে ৩০ এপ্রিল। জার্মানির মিউনিখে রেফারেন্স সিস্টেম স্থাপনের নির্ধারিত তারিখ ছিল গত ৩১ ডিসেম্বর। এখন নতুন তারিখ ৩১ মার্চ। এছাড়া একটি আরপিওসহ ডাটা সেন্টার, ডিজাস্টার রিকভারি সাইট, পারসোনালাইজেশন সেন্টার ও এক সেট ই-গেট স্থাপনের নির্ধারিত তারিখ ১৫ জানুয়ারি থেকে পিছিয়ে ১৫ জুন নির্ধারণ করা হয়েছে।
ই-পাসপোর্ট প্রিন্টিংয়ের কার্যক্রম শুরুর নির্ধারিত তারিখ ৩০ জানুয়ারি থেকে পিছিয়ে ৩০ জুন করা হলেও তা আরেক দফা পিছিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন পাসপোর্ট অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, এরই মধ্যে বিদ্যমান মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত প্রিন্টিং মেশিনসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব পুরনো যন্ত্রপাতি কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে পাসপোর্ট প্রিন্টিংসহ যাবতীয় কাজ চলানো হচ্ছে।
একই সঙ্গে অধিদফতরের গুদামে থাকা পাসপোর্ট বইয়ের মজুদও ফুরিয়ে আসছে। ফলে যথাসময়ে ই-পাসপোর্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে একদিকে যেমন নতুন করে এমআরপি বুকলেট সংগ্রহে জটিলতা দেখা দেবে, অন্যদিকে নতুন পাসপোর্টপ্রত্যাশীরাও বড় ধরনের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়বেন।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates