ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরের বাসিন্দা আন্তোনিও। বন তৈরির নেশায় সিয়েরা দ্য মান্টিকুয়েরা মাউন্টেন এলাকায় ১৯৭৩ সালে ৭৭ একর পতিত জমি কিনেছিলেন তিনি। ৪০ বছর ধরে সেখানে প্রায় ৫০ হাজার গাছ লাগিয়েছেন। আজ সেই জমি বিশাল অরণ্য হয়ে উঠেছে। নিজের হাতে গড়া এই সবুজ অরণ্যই এখন ৮৪ বছর বয়সী আন্তোনিওর ঘর-সংসার। এই বনের এক পাশে একটি ঘর করে সেখানেই থাকেন তিনি। এই ঘর আর বনই যেন তাঁর জীবন।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তোনিও যখন বন তৈরির উদ্দেশে জমি কেনেন, সে সময় ব্রাজিলে শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য বিশাল বিশাল বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছিল। গাছ কমে যাওয়ায় সেসব জায়গায় পানির তীব্র সংকটও দেখা দিয়েছিল। পরে দেশটির সামরিক সরকার আধুনিক কৃষির প্রসারে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তোনিও সম্পন্ন কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান। ছোটবেলায় তিনি দেখেছেন, কীভাবে বিশাল বন কেটে উজাড় করা হয়েছিল। গাছপালা না থাকায় সেখানে পানির তীব্র সংকট হয়েছিল, যা আর কখনোই ফিরে আসেনি। এ কারণে বন তৈরি করার নেশায় পেয়েছিল তাঁকে। অবশেষে ৭৭ একর জমি কেনেন তিনি। কয়েকটি গাধা আর কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে তিনি বন তৈরির কাজ শুরু করে দেন।
আন্তোনিও বলেন, ‘প্রথম দিকে মানুষ আমাকে পাগল বলত। বলত, তুমি গাছ লাগিয়ে জমিটা নষ্ট করে ফেলছ। এতে তোমার কোনো লাভ হবে না। গাছে গাছে ভরে গেলে একদিন এখানে তোমার থাকার ঘরও থাকবে না।’ সেই ৭৭ একর জমিতে বীজ বুনে বুনে ব্যক্তিগত বনে এখন প্রায় ৫০ হাজার গাছ লাগিয়েছেন আন্তোনিও।
আন্তোনিও ভিচেনতে বলেন, ‘আপনি আমার কাছে জানতে চান, আমার পরিবারে কে কে আছে; আমি বলব, এখানকার সবকিছুই আমার পরিবার। যেগুলোর আমি বীজ বুনেছিলাম, আজ সেগুলো বিশাল বৃক্ষ।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, যে সময় আন্তোনিও গাছের বীজ বুনে চলেছেন, ঠিক সে সময়ে শহরের পরিধি বাড়াতে ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ একর জমির আটলান্টিক ফরেস্ট কেটে উজাড় করা হচ্ছিল। এসওএস আটলান্টিক ফরেস্ট ফাউন্ডেশন ও আইএনপিইর জরিপ বলছে, আটলান্টিক ফরেস্টের ৬৯ শতাংশ সাও পাওলোতে ছিল। এখন মাত্র ১৪ শতাংশ বাকি আছে। এই বন উজাড়ের কারণে পানির তীব্র সংকট সৃষ্টি হয় সাও পাওলোতে। দুই বছর পর ২০১৬ সালে এই পানির সংকট কিছুটা দূর হয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার গাছ লাগানো ও পানি সরবরাহের জন্য এই অঞ্চলের কৃষকদের মাসিক ভাতা দিচ্ছেন।
আন্তোনিও ভিচেনতের বন তৈরি প্রসঙ্গে কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো মেদেইরোস বলেন, সবাই যদি আন্তোনিওর মতো একনিষ্ঠ হয়ে এসব কাজ করত, তাহলে বন তৈরি ও পানি সরবরাহের কাজটি আরও সহজ হয়ে যেত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শুরুতে পানির সংকটে পড়েছিলেন আন্তোনিও। কিন্তু ধীরে ধীরে এই বিশাল অরণ্য তৈরি হওয়ায় এখন আর পানির কোনো সমস্যা নেই তাঁর। বরং ঘন জঙ্গলের কারণে এই বনে এখন ছোট-বড় আটটি জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। আন্তোনিওর বনে সিগারেটের ধোঁয়া নেই। আছে সবুজ আর নির্মল বাতাস। দ্য মান্টিকুয়েরা মাউন্টেন এলাকার বনে ঢুকলেই জলপ্রপাতের কুলকুল শব্দও কানে আসবে।
নিজের এই বন তৈরির বিষয়ে আন্তোনিও বলেন, ‘আমি অর্থের জন্য এসব করিনি। আমি মরে গেলে সবাই এর সুফল ভোগ করবে, এ কারণেই এই বন তৈরি করেছি। তখন হয়তো মানুষ আমাকে আর পাগল বুড়ো বলেও ডাকবে না।’
No comments:
Post a Comment