অর্থ উপার্জন আর পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে কি না করছে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি শ্রমিকরা! মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জীবিকার তাগিদে বৈধ কিংবা অবৈধ, যে কোন উপায়ে পাড়ি জমাচ্ছে তারা। আর এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গিয়ে কখনো কখনো তাদের জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ আর অন্তিম মৃত্যুর রুপরেখা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের অবৈধভাবে বিদেশ যাত্রার এই অভিনব ও অবৈধ পন্থা অস্থিতিশীল করে তুলেছে জনশক্তি রপ্তানির গোটা প্রক্রিয়াকে।
তবে অবৈধভাবে বেশিরভাগ দেশে যাত্রার কল্পকাহিনীটা এক রকম হলেও ভিন্ন চিত্র দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে। দেশটিতে প্রায় দেড় লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছে। যাদের অধিকাংশই জীবন বাজি রেখে এ পথ ধরেই আফ্রিকায় পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু কেন এই পথ? কি এমন সুবিধা এভাবে দ. আফ্রিকায় যেতে? জানতে চাইলে দ. আফ্রিকা থেকে সদ্য দেশে ফিরে আসা মেহেরপুরের উজ্জ্বল হোসেন জানান, অবৈধভাবে তার বিদেশ পাড়ির কথা। বৈধভাবে আফ্রিকায় যাওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় এ পথ ধরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আফ্রিকায় যাওয়ার এই তিক্ত অভিজ্ঞতা আর ভয়াবহ সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনও ভয়ে গা আঁতকে ওঠে তার।
তার ভাষায়, একজন মানুষ কতোটা সংগ্রাম আর প্রতিবন্ধতা পেরোনোর ক্ষমতা থাকলে এ পথ পাড়ি দিতে পারে, তা সচক্ষে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।
‘২০১৪ সালের প্রথম দিককার কথা, গ্রামের অনেক প্রতিবেশি দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা আর পরিবারের দুরাবস্থা ঘুঁচিয়েছেন। সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে আমিও খুঁজছিলাম কিভাবে আফ্রিকায় যাওয়া যায়। কিন্তু তেমন কোন সুযোগ ছিল না হাতের নাগালে।
‘২০১৪ সালের প্রথম দিককার কথা, গ্রামের অনেক প্রতিবেশি দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা আর পরিবারের দুরাবস্থা ঘুঁচিয়েছেন। সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে আমিও খুঁজছিলাম কিভাবে আফ্রিকায় যাওয়া যায়। কিন্তু তেমন কোন সুযোগ ছিল না হাতের নাগালে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে অনেকে কাজের সন্ধান দেওয়ার কথা বললেও কিভাবে যাবো সে পথ কেউ দেখাতে সাহস পায়নি। তবে অনেক যোগাযোগ আর সন্ধানে একদিন মিলল সে পথের দিশা। আফ্রিকায় অবৈধ পথে শ্রমিক নিয়ে যাওয়া ঢাকার সুমন নামের এক এজেন্টের সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন আট থেকে নয় লাখ টাকা হলে দ. আফ্রিকায় যাওয়া সম্ভব। আর এজন্য পাসপোর্ট্ জমা দিতে হবে এবং ভিসা প্রক্রিয়া তারা নিজেরাই করিয়ে নিবে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌছানোর আগে কোন ধরণের টাকা-পয়সা অগ্রিম দেওয়া লাগবে না। অনেক সাহস আর বিশ্বাস নিয়ে তার মাধ্যমেই যেতে সম্মত হলাম। জানতে চাইলাম কিভাবে ভিসা পাবো? তিনি বললেন সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই। সেখানে আপনাকে পৌছে দিতে পারলেই তো হলো?’
সেই বিশ্বাস আর ভরসা নিয়ে ২০১৪ সালের মে মাসে পাসপোর্ট্ জমা আর ভিসার জন্য কিছু টাকা দিলাম তার কাছে। তারপর ১১ দিনের মাথায় আমাকে জানানো হলো আপনার পাসপোর্ট্ আর ভিসা রেডি করা হয়েছে। কবে যেতে পারবো জানতে চাইলে তিনি জানান, জুন মাসের ৫ তারিখের কথা। আরও জানালেন আপনার ফ্লাইট চট্টগ্রাম থেকে। অবাক হলাম ঢাকা রেখে চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইট হওয়ার কথা শুনে। ঢাকা থেকে কি সব ঝক্কি-ঝামেলার কথা জানালেন তিনি। ঢাকায় এসে যখন পাসপোর্ট্, ভিসা আমার কাছে দেওয়া হলো খুলেই দেখি সেখানে ট্যুরিস্ট ভিসা লেখা আছে । আর তাইওয়ানে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস থেকে আমার ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকায় কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক্ নেই। এছাড়া বাংলাদেশে দূতাবাস না থাকায় এভাবে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কোন নাগরিককে দ.আফ্রিকায় যেতে হলে শ্রীলংকা, তাইওয়ান কিংবা ভারতের মত দেশ থেকে এসব অনুমতিপত্র যোগাড় করতে হয়।
যেভাবে যাত্রা শুরু হলো:
‘চট্টগ্রাম থেকে সকাল সাড়ে ন’টায় দুবাই এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ১৯ জন বাংলাদেশির সঙ্গে আমাকেও ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হলো। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো দুবাইয়ে। যাদের সাথে পাঠানো হলো তারাও কাজের সন্ধানে দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছে। সেখানে ছয় ঘন্টা যাত্রা বিরতি শেষে কেনিয়ার নাইরোবি বিমানবন্দরে। তারপর সেখান থেকে ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়া থেকে অন্য একটা ফ্লাইটে নাইজার নিয়ে যাওয়া হলো। সেখান থেকে মোজাম্বিক নামে আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই মোজাম্বিক পর্যন্ত ভিসা দেওয়া আছে কাগজপত্রে। মোজাম্বিক বিমানবন্দরে নামতেই সেখানকার কর্ম্কর্তারা বাংলাদেশিদের দেখলে নাকি বুঝতে পারে এরা দক্ষিণ আফ্রিকা যাবে। তাই তারা বেশ সজাগ থাকে। তবে দালালদের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই তারা চুপ থাকে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের দালালরা সংযুক্ত বলে জানান তিনি।
তবে মোজাম্বিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে দিতে যারা কাজ করে তারা মূলত পাকিস্তানি এজেন্ট। সেখানে বাংলাদেশিরা নামতেই তাদের আপাদমস্তক তল্লাশি চালানো হয় এবং টাকা পয়সা থেকে শুরু করে জামাকাপড় পর্যন্ত সব কিছুই কেড়ে নেয় তারা।
‘চট্টগ্রাম থেকে সকাল সাড়ে ন’টায় দুবাই এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ১৯ জন বাংলাদেশির সঙ্গে আমাকেও ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হলো। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো দুবাইয়ে। যাদের সাথে পাঠানো হলো তারাও কাজের সন্ধানে দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছে। সেখানে ছয় ঘন্টা যাত্রা বিরতি শেষে কেনিয়ার নাইরোবি বিমানবন্দরে। তারপর সেখান থেকে ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়া থেকে অন্য একটা ফ্লাইটে নাইজার নিয়ে যাওয়া হলো। সেখান থেকে মোজাম্বিক নামে আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই মোজাম্বিক পর্যন্ত ভিসা দেওয়া আছে কাগজপত্রে। মোজাম্বিক বিমানবন্দরে নামতেই সেখানকার কর্ম্কর্তারা বাংলাদেশিদের দেখলে নাকি বুঝতে পারে এরা দক্ষিণ আফ্রিকা যাবে। তাই তারা বেশ সজাগ থাকে। তবে দালালদের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই তারা চুপ থাকে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের দালালরা সংযুক্ত বলে জানান তিনি।
তবে মোজাম্বিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে দিতে যারা কাজ করে তারা মূলত পাকিস্তানি এজেন্ট। সেখানে বাংলাদেশিরা নামতেই তাদের আপাদমস্তক তল্লাশি চালানো হয় এবং টাকা পয়সা থেকে শুরু করে জামাকাপড় পর্যন্ত সব কিছুই কেড়ে নেয় তারা।
মোজাম্বিক বিমানবন্দর থেকে বের হতেই আমাকে ধরে ফেলল দুই পাকিস্তানি দালাল। তারা এসেই আমার কাছে থাকা এগারো’শ ডলার সেটা দিয়ে দিতে বলে। আশ্চর্য্ হয়ে যাই কিভাবে এরা জানলো আমার কাছে এগারো’শ মত ডলার আছে? আমি তাদের কাছে জানতে চাই কেন ডলার দিবো? তারা আমাকে জানায় বাংলাদেশি যে এজেন্ট আমাকে মোজাম্বিকে পাঠিয়েছে তিনি দিতে বলেছেন। সত্যতা যাচাই করতে তারা ফোন ধরিয়ে দেয় বাংলাদেশি সেই এজেন্টের সাথে। তিনি জানান যে, ওদের কাছে ডলার দিলেই তারা আমাকে দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ডার পার করিয়ে দেবে। আমি নির্দ্বিধায় আমার কাছে থাকা ডলার দিয়ে দেই। তারপর সেখান থেকে আফ্রিকান এক নিগ্রো দালালের হাতে তুলে দেওয়া হলো অামাকে। সে আমার কাছে জানতে চাইলো আমার কাছে কোন ফোন আছে কিনা? সত্য কথা বলতেই সে আমার কাছ থেকে ফোনটি নিয়ে নিলো। তারপর গাড়িতে তুলে নিয়ে মোজাম্বিক বিমানবন্দর থেকে তিন’শো কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্তবতী পাহাড় ঘেরা গহীন অরণ্যে রাতের অন্ধকারে আমি আর এক ইন্ডিয়ান বাঙালীকে বর্ডারের নিকটে ছেড়ে দেওয়া হলো। তারপর বলল ‘যা বর্ডার পার হয়ে আফ্রিকায় চলে যাহ’। ছিপছিপ বৃষ্টি আর অন্ধকার রাতে পোকামাকড়ের বিকট আওয়াজে ভয়ে পুরো শরীর কুকড়ে যেতে লাগলো। সামনে পা না এগিয়ে রাতের অর্ধেকটাই কাটিয়ে দিলাম সীমান্তবতী ওই জঙ্গলে। তারপর ভোরের আলো ফুটতেই আফসা অন্ধকারে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া কেটে ঢুকে পড়লাম দক্ষিণ আফ্রিকার ভূখন্ড’।
তিনি জানান এভাবে নাকি বাংলাদেশিরা কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বহু বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করছে। প্রতিক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ জন বাঙালি বা বাংলাদেশিরা এভাবে পার হয়ে চলে যায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে শুধু আমি আর এক ভারতীয় বাঙালি এভাবে পার হয়ে গেলাম। তবে যে ১৫ জনের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকায় আসার জন্য আমি চট্টগ্রাম থেকে বিমানে উঠেছিলেন। পরে তাদের আর কোন খোঁজ পায়নি। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করতেই সেখানে রামদা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু আফ্রিকান নিগ্রো উলঙ্গ করে তল্লাশি শুরু করলো আমাদের’। ভুক্তভোগী উজ্জলের ভাষায় দ. আফ্রিকায় ১ লাখ বিশ হাজারের মত বাঙালী রয়েছে। যাদের অনেকেই এই অবৈধ পথ ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছে। তাদের প্রত্যেককে এভাবে নিগ্রো দালালরা টাকা পয়সা আর ডলারের লোভে উলঙ্গ করে তল্লাশি চালিয়েছে। বিভৎস এই নিপীড়নের সময় কোন একটিতে ত্রুটি পেলেই হয়! হয় মৃত্যু, নয়তো দেশে ফেরত।
আফ্রিকায় যাওয়ার এই অবর্ণনীয় জীবন সংগ্রামের বাইরে অন্যভাবে যাওয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, “সম্প্রতি কিছু দালাল বা এজেন্ট যারা বেশি অর্থ্ নিয়ে শ্রমিকদের সরাসরি দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানবন্দর পার করিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা জোহানেসবার্গ্, কেপটাউন, ডারবান কিংবা প্রিটোরিয়ার মত বড় বিমান বন্দর গুলো ব্যবহার করে বাংলাদেশিদের আফ্রিকায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

উজ্জ্বলের মত মুজিবনগর উপজেলার আমিনুল ইসলাম, সাজু মোল্লাসহ আরও অনেকে অবৈধভাবে দ. আফ্রিকায় পাড়ি দিয়েছে। তারা জানান আফ্রিকায় যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল বাড়িতে আর কোনদিন ফিরে যেতে পারবো কিনা তার কোন আশা বা সম্ভাবনাই আমাদের ছিলো না। দালালদের অত্যাচার আর দিরে পর দিন অনাহারের মধ্যে কাটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছেছেন তারা। তবে এভাবে দ. আফ্রিকায় যেন আর কোন বাংলাদেশি না যায় সেজন্য তারা শ্রমিকদের অনুরোধ জানিয়েছে।
আফ্রিকা মহাদেশের সম্পদশালী এই দেশটিতে বাংলাদেশিদের জন্য রয়েছে ব্যবসা বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা । বেসরকারি হিসেবে, বৈধ বা অবৈধভাবে প্রায় দেড় লক্ষাধিক বাঙালি দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস করছে । তারা বৈধ বা অবৈধভাবে বছরে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন টাকা দেশে পাঠায় । যার অধিকাংশ পাঠানো হয় হুন্ডির মাধ্যমে। কিন্তু অবৈধভাবে যেসব শ্রমিক লাখ লাখ টাকা খরচ করে দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশ অর্থ্ যাচ্ছে কালোবাজারীদের পকেটে। এছাড়া দেশটিতে প্রবেশের এই প্রক্রিয়ায় বহু বাংলাদেশির প্রাণ হারাতে হয়েছে দুর্বৃত্তদের হাতে। তাই দ. আফ্রিকায় সমস্ত ব্যবসায়ী প্রবাসীদের দাবি বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস খোলা হোক । তাতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাঙ্গালীদের অধিকার রক্ষায় সরকারের পক্ষে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে । এতে করে দেশটিতে আরো কম খরচে দক্ষ ও অদক্ষ জনবল রপ্তানি করা সম্ভব হবে । ফলে এই প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের অর্থনীতির ধারা পরিবর্তন হয়ে যাবে। সেই সাথে বিদেশে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সরকারের ভূমিকা অনেক প্রশংসনীয় হবে।
No comments:
Post a Comment