নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার ঘটনায় অবশেষে বাতিল করা হয়েছে ওই বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ (স্কুল ম্যানেজিং কমিটি)। একই সঙ্গে ওই লাঞ্ছিত প্রধান শিক্ষককে স্বপদে বহাল করেছে সরকার। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ওই স্কুলের জন্য নতুন পরিচালনা পর্ষদও গঠন করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষককে মারধর ও কান ধরে উঠবোস করানোর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান।
এদিকে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছিত করার ষষ্ঠ দিনে গতকালও সারা দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। সকালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এক মানববন্ধনে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তাঁরা এই ঘটনাকে কলঙ্কজনক আখ্যায়িত করে দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। সারা দেশেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়েও অব্যাহত ছিল প্রতিবাদ। তবে সকাল ১১টায় শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।
সূত্র জানায়, প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন বলে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেই অভিযোগের কোনো প্রমাণ পায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্তদল। এ ছাড়া গত ১৬ মে শ্যামল কান্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও এর আগে তাঁকে কোনো কারণ দর্শানো নোটিশও দেওয়া হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী কাউকে বহিষ্কারের আগে তাঁকে অবশ্যই কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে। এরপর অভিযুক্তের জবাব পাওয়ার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু শ্যামল কান্তির বেলায় এর কোনো কিছুই করা হয়নি। এমনকি ওই দিন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি দেশে ছিলেন না বলে তদন্ত কমিটি জেনেছে। তাহলে কিভাবে প্রধান শিক্ষকের বরখাস্তের চিঠি স্বাক্ষরিত হলো, সে ব্যাপারে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া গত ১৩ মে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সর্বশেষ সভা হয়। ওই দিন প্রধান শিক্ষককে বরখাস্তসংক্রান্ত কোনো এজেন্ডা থাকারও প্রমাণ পাননি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
শিক্ষামন্ত্রীও গতকাল তাঁর সংবাদ সম্মেলনে শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে আনীত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে জানান। তিনি বলেন, ‘একজন প্রধান শিক্ষককে যেভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তার নজির অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ। একটা সভ্য দেশে এটা হতে পারে না। তবে আমরা এ ঘটনায় নিয়মনীতি অনুসারে তদন্ত কমিটি করেছি। তারা গত বুধবার রাতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেটা পর্যালোচনা করেই আমরা পরিচালনা কমিটি বাতিল ও শিক্ষককে স্বপদে বহাল রাখার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মন্ত্রী বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে সমস্যাগুলো তুলে আনা হয়েছে। একজন শিক্ষককে এই ধরনের লাঞ্ছনা অবশ্যই ঘৃণ্য কাজ। এ ক্ষেত্রে স্কুল পরিচালনা কমিটির যে দায়িত্ব ছিল তারা তা পালন করেনি। তারা যোগ্য নয়। তাই আমরা পরিচালনা কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপাতত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু পরিচালনা কমিটিই বাতিল করা হয়েছে, তাই তাদের বরখাস্তও কার্যকর হবে না। আর তাদের সিদ্ধান্ত বেআইনিও। তাই ওই শিক্ষক স্বপদে বহাল থাকবেন ও দায়িত্ব পালন করবেন। এভাবে একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলো।’
হাইকোর্টের নির্দেশনার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ওপর যা বর্তায় সেগুলো আমরা করব। তবে এখানে আইনশৃঙ্খলার বিষয় জড়িত আছে। সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে যা যা করণীয়, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি সেসব বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন। ইতিমধ্যেই ১৪ দল তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছে। তাই আমাদের রাখঢাক করার কোনো বিষয় নেই।’
শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ পেয়েছে কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের কিছু আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগটা অন্য একটা ইস্যু নিয়ে। সেটা ৮ মের ঘটনা। তদন্তে পরিচালনা কমিটির বাইরে অন্য কারো ভূমিকা আমরা পাইনি।’
স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তাসহ অন্যদের ভূমিকার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিবেদনটি সবেমাত্র পেয়েছি। আমরা তাৎক্ষণিক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বিষয়টি আরো সময় নিয়ে পর্যালোচনা করব। কার কী ভূমিকা ছিল, সেটাও পর্যালোচনা করব। এরপর আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু করা দরকার তা আমরা করব।’
মন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষকরা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁরাই আমাদের আসল নিয়ামক শক্তি। তাঁরাই আমাদের শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই সব শিক্ষকের মর্যাদা যাতে বৃদ্ধি পায়, সেই চেষ্টা আমরা করে যাব। তবে ব্যক্তি হিসেবে কোনো শিক্ষক অন্যায় করলে এ জন্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কোনো বাধা নেই।’
গত ১৩ মে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। এরপর গত ১৬ মে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মো. ইউসুফকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত রবিবার তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে যায়। গত রাতে সিলগালা অবস্থায় তাঁদের প্রতিবেদন তাঁরা মাউশির মহাপরিচালকের হাতে তুলে দেন। তিনি তা শিক্ষামন্ত্রীকে হস্তান্তর করেন। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাসচিব মো. সোহরাব হোসাইন, মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন প্রমুখ।
শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে মানববন্ধন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার ঘটনায় একযোগে ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই মানববন্ধন করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন তাদের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এই আয়োজন করে।
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধনের আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। শিক্ষকরা বলেন, ‘সরি স্যার, আমরা লজ্জিত ও বিব্রত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আমরা করজোরে ক্ষমা চাচ্ছি। এ অপমান দেশের শিক্ষক সমাজের।’
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘শিক্ষা পরিবারে সাড়ে চার কোটি মানুষ সংযুক্ত আছে বলেই এই শিক্ষাঙ্গনকে অস্থিতিশীল করতে চায় একটি চক্র। ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে এই ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির চক্রান্তের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। শিক্ষকের অপমান ও অসম্মানে ছাত্র-শিক্ষকরা জেগে উঠেছে। আমরা শুধু পরিচালনা কমিটিই বাতিল নয়, এর সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও শাস্তি দাবি করছি।’
নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, ‘একজন শিক্ষককে পেছন থেকে আক্রমণ ও হত্যার বিরুদ্ধে কয়েক দিন আগে আমরা এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু এবারের ঘটনা একটু আলাদা। দিবালোকে একজন শিক্ষককে কান ধরে উঠবোস করানো হয়েছে! আমরা তাঁর চাকরি ফিরিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাঁর আত্মসম্মানকে হত্যা করেছি, সেটি ফিরিয়ে দিতে পারব? ওই শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষক সমাজের আত্মমর্যাদাকেও হত্যা করা হয়েছে। অপমানের প্রতিকার চাকরি ফিরিয়ে দিলেই হবে না, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
মানববন্ধনে আরো বক্তব্য দেন ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমদ প্রমুখ।
ঘটনা তদন্তে পুলিশকে অনুমতি আদালতের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবোস করানোর ঘটনা তদন্তে পুলিশকে অনুমতি দিয়েছেন আদালত। বন্দর থানা পুলিশ শিক্ষককে কান ধরে উঠবোস করানোর ঘটনাকে ‘মানহানিকর অপরাধ’ বিবেচনায় তদন্তের আবেদন করলে গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অশোক কুমার দত্ত এ অনুমতি দেন।
No comments:
Post a Comment