সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হারে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে শিশুদের জীবন। সন্তান কার সঙ্গে থাকবে—এ নিয়ে টানাহেঁচড়াও কম হয় না। এমনকি কখনো কখনো বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অথচ এ বিষয়ে ইসলামের নীতিমালা অনুসরণ করা হলে এ নিয়ে বিভেদ থাকার কথা নয়।
জন্মগতভাবে সন্তান মাতা-পিতা উভয়ের। বংশগত দিক দিয়ে সন্তান পিতার বলে গণ্য হয়ে থাকে। তবে সন্তানের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী তার দায়িত্বভার মাতা-পিতা উভয়ের ওপরই অর্পিত। কোনো কারণে মাতা-পিতার বিচ্ছেদ হয়ে গেলে তখন সন্তানের লালন-পালনবিষয়ক জটিলতা সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে শরিয়তের দিকনির্দেশনা হলো—শিশুসন্তানের লালন-পালনের অধিকার মায়ের। আর শিশু যত দিন পর্যন্ত পানাহার, পোশাক পরিধান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্যে মায়ের মুখাপেক্ষী, তত দিন পর্যন্ত মা শিশুকে নিজ জিম্মায় রাখতে পারে। এর পরিমাণ ছেলেশিশুর জন্য সাত বছর, আর মেয়ের ক্ষেত্রে বালেগা হওয়া পর্যন্ত। ওই সময় শেষ হওয়ার আগে শরিয়ত সমর্থিত কোনো কারণ ছাড়া সন্তানকে তার মা থেকে পৃথক করা বৈধ নয়। ওই সময় পার হলে পিতা শিশুসন্তানকে মায়ের কাছ থেকে নিজ জিম্মায় নিয়ে আসতে পারে। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩/৫৬৬)
সন্তান বড় হলে যার সঙ্গে ইচ্ছা থাকতে পারবে।
শিশুর ভরণপোষণের ব্যয়ভার
সন্তান যার কাছেই প্রতিপালিত হোক না কেন, তার ভরণপোষণের ব্যয়ভার পিতার ওপরই ন্যস্ত থাকবে। তবে সন্তানের নিজস্ব সম্পত্তি থাকাবস্থায় তার সম্পদ থেকে ব্যয় করা যাবে, যদি পিতার সামর্থ্য না থাকে। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩/৫৫৭)
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর পিতার কর্তব্য হলো, বিধি মোতাবেক (শিশুদের) মাতাদের খাবার ও পোশাক প্রদান করা। সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো বক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় না। আর কষ্ট দেওয়া যাবে না কোনো মাকে তার সন্তানের জন্য কিংবা কোনো বাবাকে তার সন্তানের জন্য। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৩)
যেসব কারণে মা এ অধিকার হারাবেন
এক. নীতিহীন জীবন যাপন করলে। দুই. যদি এমন কারো সঙ্গে তার বিয়ে হয়, যিনি শিশুটির মাহরাম আত্মীয় নয়, কেননা তখন সে স্বামীর বাড়িতে স্বামীর হক আদায় করতে গিয়ে শিশুর লালন-পালনে ব্যাঘাত হবে। তিন. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে ও দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে। চার. যদি সে ইসলাম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে। পাঁচ. যদি সন্তানের পিতাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় দেখতে না দেওয়া। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৪২)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত। একদা এক মহিলা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এই সন্তানটি আমার গর্ভজাত, সে আমার স্তনের দুধ পান করেছে এবং আমার কোল তার আশ্রয়স্থল। তার পিতা আমাকে তালাক দিয়েছে। এখন সে সন্তানটিকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, তুমি অন্যত্র বিয়ে না করা পর্যন্ত তুমিই তার অধিক হকদার। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২২৭৬)
তবে মা যদি তার নতুন সংসারে সন্তানকে হেফাজতে রাখতে পারে এবং মায়ের পরবর্তী স্বামী এ সন্তানকে লালন-পালনে সন্তুষ্ট থাকে, সে ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে কোনো সমস্যা নেই। (ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া ৪/৪২৫)
মায়ের অবর্তমানে শিশুর জিম্মাদারি
মায়ের অবর্তমানে শিশুর জিম্মাদারি মায়ের নিকটাত্মীয়দের কাছে চলে যাবে। এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ক্রমধারা অবলম্বন করা হবে। মায়ের অবর্তমানে নাবালক শিশুর হেফাজতকারী পর্যায়ক্রমে হবেন মায়ের মা (নানি, নানির মা—যত ওপরের দিকে হোক), এরপর পিতার মা (দাদি, দাদির মা—যত ওপরের দিকে হোক), আপন বোন (মা, বাবা একই), বৈপিত্রেয় বোন (মা একই কিন্তু বাবা ভিন্ন), আপন বোনের মেয়ে (যত নিচের দিকে হোক), বৈপিত্রেয় বোনের মেয়ে (যত নিচের দিকে হোক), পূর্ণ খালা (যত ওপরের দিকে হোক), বৈপিত্রেয় খালা (যত ওপরের দিকে হোক), আপন ফুপু (যত ওপরের দিকে হোক)। উল্লেখ্য, আত্মীয়রা ক্রমানুসারে একজনের অবর্তমানে বা অযোগ্যতার কারণে অন্যজন জিম্মাদারিত্বের অধিকারী হবেন।
মা অথবা অন্য নারী আত্মীয়দের অবর্তমানে শিশুর জিম্মাদার হতে পারেন যাঁরা তাঁরা হলেন : বাবা, বাবার বাবা (যত ওপরের দিকে হোক), আপন ভাই, রক্তের সম্পর্কের ভাই, আপন ভাইয়ের ছেলে, রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে, বাবার আপন ভাইয়ের ছেলে, বাবার রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে। স্মর্তব্য যে একজন পুরুষ আত্মীয় একজন নাবালিকার জিম্মাদার শুধু তখনই হতে পারবেন, যখন তিনি ওই নাবালিকার মাহরাম (নিষিদ্ধ স্তরের) আত্মীয় হন। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৪, রদ্দুল মুহতার : ২/৬৩৮)
শিশুসন্তানের সাক্ষাতের অধিকার
সন্তান যার কাছেই প্রতিপালিত হোক, মা-বাবার কোনো একজন যদি সন্তানকে দেখতে চায় অথবা সন্তান মা-বাবাকে দেখতে চায়, তাহলে অবশ্যই সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৬৪৩)
এ বিষয়ে আরব-অনারবের সব আলেম একমত। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে তা জুলুম ও অন্যায় হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
লেখক : ফতোয়া গবেষক
ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার