দুর্ভিক্ষের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া আফ্রিকার তিনটি দেশে ৭০ বছরের মধ্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় ঘোষণা করা হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত বৈদেশিক সাহায্য কর্তন করার হুমকি। ফলে বিশ্বের শীর্ষ জরুরি দাতাদেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহাসিক ভূমিকা থেকে সরে আসছে।
মার্কিন কংগ্রেসে যদি এটি দৃঢ়ভাবে অনুমোদিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি আফ্রিকার বর্তমান সঙ্কটে অবদান না রাখে; সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মহাদেশটির ক্রমবর্ধমান খরা এবং দুর্ভিক্ষ সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে। এর মধ্য অন্যতম হচ্ছে ইউরোপের দিকে অভিবাসীদের নতুন করে ঢেউ শুরু হবে এবং সম্ভবত চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো আরো সমর্থন পাবে।
নাইজেরিয়া, সোমালিয়া এবং দক্ষিণ সুদানের ক্ষুধা সংকটে সংঘাত ইন্ধন যুগিয়েছে। দেশ তিনটি দুর্ভিক্ষের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে এবং প্রায় একই সময়ে সংগঠিত হয়েছে দুর্ভিক্ষের আঘাত। দেশ তিনটির প্রায় ১৬ কোটি মানুষ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চরম মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে।
দক্ষিণ সুদানের দু’টি কাউন্টিতে ইতোমধ্যে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা করা হয়েছে এবং সেখানে খাদ্যের অভাবে ১ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুর কিনারায় দাড়িয়ে আছে বলে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, অতিরিক্ত খরার কারণে সোমালিয়ায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে ও দেশটির ২.৯ মিলিয়ন জনগণ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। যার ফলে দেশটিতে একটি দুর্ভিক্ষ ঘটাতে পারে। উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায় তীব্র অপুষ্টি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বোকো হারাম চরমপন্থীদের প্রভাবিত এলাকাগুলোতে এটি আরো বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে।
চলতি মাসে সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদান পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘ মানবিক সংস্থার প্রধান স্টিফেন ও'ব্রায়েন নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, ‘জাতিসংঘ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আমরা বৃহত্তম মানবিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছি।’
ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ইয়েমেনে ক্ষুধা ‘বিপর্যয়’ এড়াতে মার্চের শেষ নাগাদ কমপক্ষে ৪.৪ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।
কিন্তু জাতিসংঘ তথ্য অনুযায়ী, এখনো পর্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র ১০ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত বাজেটে সহায়তা কর্মসূচি ‘একেবারে’ কর্তন করতে বলা হয়েছে বলে গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্টের বাজেট পরিচালক মাইক মিউলভ্যানি সাংবাদিকদের জানান। দেশটির এই সহায়তা কর্মসূচি পৃথিবীর সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষদের কল্যানে ব্যয় করা হতো।
মাইক মিউলভ্যানি বলেন, ‘বিদেশিদের জন্য বাজেটের একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়া মানুষদের জন্য কিছুটা বেশি খরচ করা হবে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে জাতিসংঘের বৃহত্তম দাতা দেশ এবং অন্য যেকোন মহাদেশের চেয়ে আফ্রিকা মহাদেশে দেশটি সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে থাকে।
২০১৬ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে দেশটি ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছিল, যা তার মোট বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত বাজেটের অধীনে এই সহায়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হতে পারে মনে করছেন দেশটির সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তারা।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে ওবামা প্রশাসনের সাবেক উপসহকারী সচিব স্টিভেন ফেল্ডস্টেইন বলেন, ‘একটি দ্বিদলীয় ঐক্যমত্যে এই ধরনের হুমকি আমি কখনো দেখিনি। খাদ্য সাহায্য ও মানবিক সহায়তা প্রোগ্রাম নৈতিকভাবে অপরিহার্য এবং তা আমাদের নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত জরুরি।’
ডব্লিউএফপি’র আফ্রিকা মুখপাত্র ডেভিড ওর গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই মুহুর্তে বাজেটের কোনো কর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো সহায়তা বাজেট যত বেশি নাটকীয়ভাবে কর্তন করা হবে...মানুষের দুর্ভোগও তত বেশি বৃদ্ধি পাবে।’
আটলান্টিক কাউন্সিলে আফ্রিকা সেন্টারের প্রধান জে পিটার ফাম বলেন, ‘নাইজেরিয়া, সোমালিয়া এবং দক্ষিণ সুদানের ক্ষুধা সংকট আরো বেশি বেদনাদায়ক কারণ এগুলো মনুষ্যসৃষ্ট বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন সোমালিয়া ও নাইজেরিয়ার পরিস্থিতিতে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।’
২০১৩ সাল থেকে দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে দেশটির কয়েক সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে প্রতিহত করা হয়েছে। নাইজেরিয়া ও সোমালিয়ায় চরমপন্থী গ্রুপ বোকো হারাম ও আল-শাবাব পরাজয়ে অনমনীয় তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে এবং এখনো এই উভয় সংগঠনের দখলে অনেক অঞ্চল রয়েছে; যা সহায়তা প্রচেষ্টাকে আরো জটিল করেছে।
ট্রাম্পের বৈদেশিক সাহায্য কর্তন অনুমোদিত হলে মানবিক তহবিলের বোঝার সংকট ব্রিটেনের মত বড় দাতা দেশগুলোর ওপর স্থানান্তরিত হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ভূমিকা অনেকটাই হ্রাস পাবে।
বুধবার সিনেটের ‘ফরেন রিলেশনস’ কমিটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইনস্টিটিউট অব পীস’ এর সভাপতি ন্যান্সি লিন্ডবর্গ বলেন, ‘মার্কিন সরকারের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য অবদান ছাড়া জাতিসংঘ অন্যান্য দাতাদের কাছ খুব বেশি সহায়তা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। এমনকি ন্যূনতম জীবনদায়ী চাহিদা পূরণ করতেও হিমশিম খেতে হবে।’
অন্যদিকে, প্রতিবেশি আফ্রিকান দেশগুলো দুর্ভিক্ষের তাৎক্ষণিক ফলাফল অনুভব করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান জানান, গত জুলাই মাস থেকে দক্ষিণ সুদানের পাঁচ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি উদ্বাস্তু উগান্ডাতে প্রবেশ করেছে। যার ফলে দেশটি এখন সর্বাধিক চাপের মুখে রয়েছে।
অন্যরা ক্ষুধার তাড়নায় পালিয়ে ইউরোপের দিকে ছুটছে।
No comments:
Post a Comment