রাজধানীতে রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে পুলিশ নানা উদ্যোগ নিলেও থামেনি ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল। ছবি:নুর হুসাইন
রাজধানীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ও রাস্তার মোড়ে ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার উপর দিয়েই পারাপার হচ্ছে। এতে প্রতিদিনই মৃত্যুর ঘটনাসহ ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। নগরবাসীকে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে চলাচলে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে ফুটওভার ব্রিজকে ফুল দিয়ে সাজানো, রাতের বেলায় পর্যাপ্ত আলো ও ফুটওভার ব্রিজগুলো সারাক্ষণ তত্ত্বাবধায়নের জন্য লোক রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি পথচারীদের রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ভ্রাম্যমাণ আদালত। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করায় ওই দিন ৯১ জনকে বিভিন্ন অংকে জরিমানা করা হয়েছে। তবুও মানুষ ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে চলাচল না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পারাপার হতে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন।
বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আমার একটা দুঃখ, আমি অনেক ফুটওভার ব্রিজ করেছি। শতাধিক ফুটওভার ব্রিজের কাজ শুরু করে শেষ করেছি। এসব করার আগে প্রত্যেকেরই দাবি থাকে, এসব না করলেই নয়। মানুষ ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের দাবির ব্যাপারে যতটা উচ্চকিত, ব্যবহারের ব্যাপারে আমি অনেকের মধ্যে একটা আলস্য ও অনাগ্রহ দেখতে পাই।
জানা গেছে, রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মোট ১০০টির বেশি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশনে রয়েছে ৫৬টি। এর বেশিরভাগই ব্যবহার করেন না পথচারীরা। চরম ঝুঁকিপূর্ণ জানার পরও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের বেশিরভাগ পথচারীরই চরম অনীহা। অবশ্য পথচারীদের অভিযোগ, এসব ফুটওভার ব্রিজের অনেকগুলোই রাতের বেলা ভবঘুরে, মাদকাসক্ত ও ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের দখলে থাকে। দিনের বেলায়ও অনেক ফুটওভার ব্রিজ ভবঘুরে, মাদকাসক্ত ও হকারদের দখলে থাকে। কোথাও গড়ে উঠেছে অঘোষিত গণশৌচাগার। এছাড়া বিশেষ করে রাতে ছিনতাইকারীরা ওভারব্রিজ ব্যবহারকারী পথচারীদের কাছ থেকে মালামাল ছিনিয়ে নেয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও কেইস প্রজেক্ট প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সেহাব উল্লাহ বলেন, জনগণকে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পারাপারে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকি। এর মধ্যে রয়েছে গণসচেতনতামূলক র্যালী, সভা, সমাবেশ, সেমিনার, পোস্টার, লিফলেট, ফেস্টুন, ব্যানার, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞাপনসহ এবিষয়ে পুলিশকে ট্রেনিং প্রদান করা হয়।এছাড়া রাস্তার মিডইয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়। যাতে মানুষ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সহজে রাস্তা পারাপার না হতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও কেইস প্রজেক্ট প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সেহাব উল্লাহ বলেন, জনগণকে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পারাপারে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকি। এর মধ্যে রয়েছে গণসচেতনতামূলক র্যালী, সভা, সমাবেশ, সেমিনার, পোস্টার, লিফলেট, ফেস্টুন, ব্যানার, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞাপনসহ এবিষয়ে পুলিশকে ট্রেনিং প্রদান করা হয়।এছাড়া রাস্তার মিডইয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়। যাতে মানুষ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সহজে রাস্তা পারাপার না হতে পারে।
তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন শুধু ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করেই দায়িত্ব শেষ করে না। জনগণ যাতে নিরাপদে ও সুন্দর পরিবেশের মাধ্যমে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পারাপার হতে পারে সে জন্যও সিটি কর্পোরেশন নিয়েছে নানা পদক্ষেপ। ঢাকা শহরের প্রতিটা ফুটওভার ব্রিজকে ফুলের টব দিয়ে সাজানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুটি ফুটওভার ব্রিজ ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্রমান্বয়ে সবগুলোই সাজিয়ে দেয়া হবে। এছাড়া রাতের বেলায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফুটওভার ব্রিজগুলো সারাক্ষণ তত্ত্বাবধায়ন করার জন্যও লোক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যা মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে চলাচল করতে পারে সে দিকে আমাদের নজর রয়েছে।
পথচারীবান্ধব ফুটওভার ব্রিজ যথেষ্ট ব্যবহার না হওয়ার কারণ হিসেবে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’র চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, রাজধানীতে শতাধিক ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও পথচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়ে পারাপার হচ্ছেন। এমনকি নিচ দিয়ে সামান্য ফাঁকা জায়গা সেটা দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন। ওভারব্রিজগুলোর নিচ দিয়ে সড়ক বিভাগের ৩০০ থেকে ৪০০ ফুট লম্বা রেলিং বা ব্যারিকেড দেয়া থাকে। পথচারীরা এর মধ্যেও রাস্তা পারাপারের ফাঁক বের করে নেয়। আর সেটুকু দিয়েই চলে পারাপারের প্রতিযোগিতা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীতে পর্যাপ্ত ফুটওভার ব্রিজ থাকার পরও মানুষ তা ব্যবহার করে না। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ফুটওভার ব্রিজের নীচদিয়ে রাস্তা পারাপার হয়ে থাকে। এতে করে নানা সময় ঘটে যাচ্ছে নানান দুঘর্টনা। তিনি বলেন, নগরবাসীকে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে চলাচলে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম হল ফুটওভার ব্রিজগুলো ফুলের টব দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার উদ্যোগ। ক্রমান্বয়ে ঢাকার সবকটি ফুটওভার ব্রিজকে এ কাজের আওতায় আনা হবে।
সম্প্রতি এক জরিপ মতে, রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই পথচারী। ডিএমপির তথ্য মতে, ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ২০৬ জন পথচারী মারা গেছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন ২৮৮ জন। আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা কিছুটা বেশি। আর ছোটখাটো দুর্ঘটনা তো রয়েছেই। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সম্প্রতি ১৫ দিনব্যাপী রাজধানীতে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় লক্ষ্য করেন, সব শ্রেণীর মানুষের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে নিচ দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের নিয়ে নিচ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। তিনি বলেন, এভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে যানবাহনের ধাক্কায় পথচারীদের মৃত্যু হচ্ছে, কেউবা পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। ওই সময় আসলে চালকের পক্ষে কিছুই করার থাকে না। পথচারীরা রেলিং বা ব্যারিকেডের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ মাথাটা বের করে রাস্তা পার হওয়ার জন্য দৌড় দেন, তখনই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই কেবল এমন ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল বন্ধ করা সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, নিরাপদ রাস্তা পারাপার বিষয়টি পাঠ্য বইয়ে থাকা খুবই জরুরি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম বলেন, ঢাকা শহরের মানুষের সবচেয়ে বড় দাবির মধ্যে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা রাখার জন্য ডাস্টবিন ও নিরাপদে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজের। কিন্তু এগুলো করতে গেলেই আমাদেরকে পদেপদে বাধার সম্মুখিন হতে হয়। জনসাধারণের সুবিধামতো স্থানে এ সমস্ত ডাস্টবিন ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ না করা গেলে এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। তিনি বলেন, বিশেষ করে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, অনেক সচেতন ব্যক্তিও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে যখন ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে পথচারীদের সুবিধার জন্য, সেই ব্রিজ দিয়ে যদি পথচারীরা পারাপার না হন এটা সত্যিই দুঃখজনক। তিনি বলেন, যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদের ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে নিচ দিয়ে রাস্তা পারাপার করাচ্ছে সেসব সন্তানরাও বড় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়েই রাস্তা পার হবে।
এবিষয়ে একাধিক পথচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় দেড়তলা পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে, আবার নিচে নামতে কষ্ট হওয়ার কারণে মানুষ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার এড়িয়ে চলেন। এছাড়া যৌনকর্মী, হিজড়া, ছিনতাইকারী ও ভিক্ষুকসহ হকারদের কারণে ব্রিজের পথ সরু হয়ে যাওয়ায় গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগায় অধিকাংশ নারী ব্রিজে উঠতে চায় না।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুস সোবহান বলেন, যারা শারীরিকভাবে অসমর্থ তারা কিভাবে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করবেন এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেই। তাছাড়া রাস্তায় পথচারীদের হাঁটার জন্য বর্তমানে কোনো সাইন (জেব্রাক্রসিং) রাখা হয় না। মাঝে মধ্যে কিছু সাইন রাখা হলেও তা ভালভাবে দেখাও যায় না বলে দাবি করেন তিনি। তবে, সচল পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা কর্তা ব্যক্তিদের জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এ পরিবেশবিদ।
No comments:
Post a Comment