আর্থিক সচ্ছলতা, উন্নত ভবিষৎতসহ নানা কারণে প্রতিবছর প্রচুর বাংলাদেশি পাড়ি জমায় বিদেশে। জীবনমানের উন্নতির আশায় দেশ ছাড়লেও অনেক দেশেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা নূন্যতম নিরাপত্তা ও সুরক্ষা পাচ্ছে না। কিছু দেশ স্থায়ীভাবে বসবাসের ক্ষেত্রে নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আবার অনেক দেশই আছে যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশি ও অন্য প্রবাসীরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সম্প্রতি নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনস নামক একটি প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে প্রবাসীদের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপের ফল অনুসারে তারা প্রবাসীদের কাছে শীর্ষ ১২টি নিরাপদ দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। জরিপ পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ১৯১টি দেশে বসবাসরত ১৭৪ জাতিগোষ্ঠীর ১৪ হাজার ৩০০ জন প্রবাসীর কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল ব্যক্তিগত এবং আরথিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে কোন দেশকে তারা সবচেয়ে নিরাপদ মনে করেন। জরিপে, প্রবাসীরা নিরাপদ দেশ হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নাম উল্লেখ করেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নেই সেই তালিকায়।
বিশ্বের নিরাপদ ১২টি দেশ
১. ব্রাজিল : ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র। এছাড়াও জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। ৮,৫১৪,৮৭৭ বর্গকিলোমিটার (৫,২৯০,৮৯৯ বর্গমাইল) আয়তনের এই দেশটিতে বসবাসকৃত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৯ কোটি। এটি আমেরিকার একমাত্র পর্তুগিজভাষী দেশ, এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ পর্তুগিজভাষী রাষ্ট্র।
ব্রাজিলে পূর্বভাগ আটলান্টিক মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত। যার উপকূলীয়ভাগের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭,৪৯১ কিমি (৪,৬৫৫ মা)। ব্রাজিলের উত্তরে রয়েছে ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম, ও ফ্রান্সের সামুদ্রিক দেপার্ত্যমঁ ফরাসি গায়ানা। এছাড়াও এর উত্তর-পশ্চিমভাগে কলম্বিয়া; পশ্চিমে বলিভিয়া ও পেরু; দক্ষিণ-পশ্চিমে আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে, এবং সর্ব-দক্ষিণে দক্ষিণে উরুগুয়ে অবস্থিত। ব্রাজিলীয় সীমানায় আটলান্টিক মহাসাগরের বেশকিছু দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত, যার মধ্যে রয়েছে ফের্নান্দু জি নরোনিঁয়া, রোকাস অ্যাটল, সেন্ট পিটার ও সেন্ট পল রকস, এবং ত্রিনিদাজি এ মার্চিঁ ভাজ। ব্রাজিলের সাথে চিলি ও ইকুয়েডর ব্যতীত দক্ষিণ আমেরিকার সকল দেশেরই সীমান্ত-সংযোগ রয়েছে।
১৫০০ সালে পর্তুগিজ অভিযাত্রী পেদ্রু আলভারেজ কাবরাউয়ের ব্রাজিলে এসে পৌঁছানোর পর থেকে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রাজিল ছিলো একটি পর্তুগিজ উপনিবেশ। ১৮১৫ সালে এটি যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, ও আলগ্রেভিজের সাথে একত্রিত হয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা গঠন করে। মূলত ১৮০৮ সালেই ব্রাজিলের ‘পর্তুগিজ উপনিবেশ’ পরিচয়ে ফাটল ধরে, কারণ নেপোলিয়নের পর্তুগাল আক্রমণের রেশ ধরে পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের কেন্দ্র লিসবন থেকে ব্রাজিলের রিও দি জানেইরুতে সরিয়ে নওয়া হয়। ১৮২২ সালে ব্রাজিল, পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রাথমিক ভাগে এটি ব্রাজিলীয় সাম্রাজ্য হিসেবে সার্বভৌমত্ব অর্জন করলেও ১৮৮৯ সাল থেকে এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে শাসিত হয়ে আসছে। ১৮২৪ সালে ব্রাজিলের প্রথম সংবিধান পাশ হওয়ার পর থেকে দেশটিতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থা চলে আসছে, যা বর্তমানে কংগ্রেস নামে পরিচিত। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ব্রাজিল একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র। একটি ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট, ২৬টি প্রদেশ, ও ৫,৫৬৪টি মিউনিসিপ্যালিটি নিয়ে এর যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়েছে।
ক্রয়ক্ষমতা সমতা ও মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ভিত্তিতে ব্রাজিলের অর্থনীতি বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতি। ব্রাজিলের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। এর অর্থনৈতিক সংস্কার আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশটিকে একটি নতুন পরিচিতি দিয়েছে।
ব্রাজিল জাতিসংঘ, জি-২০, সিপিএলপি, লাতিন ইউনিয়ন, অর্গানাইজেশন অফ ইবেরো-আমেরিকান স্টেটস, মার্কুসাউ ও ইউনিয়ন অফ সাউথ আমেরিকান নেশন্স, এবং ব্রিক দেশগুলোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্রাজিল জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশের দিকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান একটি দেশ হিসেবে বিবেচিত। ব্রাজিলে বিভিন্ন প্রকারের প্রকৃতি সংরক্ষণকেন্দ্র ও অভয়ারণ্য বিদ্যমান। এছাড়াও দেশটি সমৃদ্ধ খনিজসম্পদের অধিকারী, যা বিভিন্ন সময়ে এর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
ব্রাজিলে বিভিন্ন জাতের লোকের বাস। আদিবাসী আমেরিকান, পর্তুগিজ বসতিস্থাপক এবং আফ্রিকান দাসদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ব্রাজিলের জাতিসত্তাকে দিয়েছে বহুমুখী রূপ। ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র পর্তুগিজ উপনিবেশ। ১৬শ শতকে পর্তুগিজদের আগমনের আগে বহু আদিবাসী আমেরিকান দেশটির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ১৬শ শতকের মধ্যভাগে পর্তুগিজেরা কৃষিকাজের জন্য আফ্রিকা থেকে দাস নিয়ে আসা শুরু করে। এই তিন জাতির লোকেদের মিশ্রণ ব্রাজিলের সংস্কৃতি, বিশেষ করে এর স্থাপত্য ও সঙ্গীতে এমন এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য এনেছে কেবল ব্রাজিলেই যার দেখা মেলে। ১৯শ শতকের শেষ দিকে ও ২০শ শতকের গোড়ার দিকে ব্রাজিলে আগমনকারী অন্যান্য ইতালীয়, জার্মান, স্পেনীয়, আরব, ও জাপানি অভিবাসীরাও ব্রাজিলের সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ,ইন্ডিয়ান রাও রয়েছেন ব্রাজিল জুড়ে । মিশ্র সংস্কৃতির দেশ হলেও কিছু কিছু আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ব্রাজিলীয়, ইউরোপ ও এশিয়া থেকে আগত অ-পর্তুগিজ অভিবাসী, এবং আদিবাসী আমেরিকানদের অংশবিশেষ এখনও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও রীতিনীতি ধরে রেখেছে। তবে পর্তুগিজ সংস্কৃতির প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। পর্তুগিজ এখানকার প্রধান ভাষা এবং রোমান ক্যাথলিক প্রধান ধর্ম।
২. লুক্সেমবার্গ: ইউরোপ মহাদেশের আয়তনে সবচেয়ে ছোট দেশ লুক্সেমবার্গ। ক্ষুদ্রায়তনের হলেও মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পৃথিবীর প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। দেশটিতে মাত্র ৫ লাখ মানুষের বাস। কিন্তু বিশ্বের মধ্যে এখানেই অপরাধের হার সবচেয়ে কম। আর্থিক নিরাপত্তার দিক থেকেও অভিবাসীদের কাছে সবার উপরে লুক্সেমবার্গ।
৩. সিঙ্গাপুর: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপ দেশটি বিশ্বের অন্যতম একটি ধনী রাষ্ট্র। কর্পোরেট অপরাধের হার অনেক কম এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার সূচকে দেশটির অবস্থান প্রবাসীদের কাছে দ্বিতীয়।
৪. জাপান: পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপানে দক্ষ শ্রমিকের অনেক চাহিদা। এই দেশটিতে প্রচুর প্রবাসী বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য দেশটিকে পছন্দের তালিকায় রেখেছেন প্রবাসীরা।
৫. কানাডা: প্রবাসীরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সূচকের তালিকায় সেরা পাঁচের মধ্যে রেখেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডাকে। কাঠ ও খনিজ তেল আহরণ শিল্পসহ বিভিন্ন ভারী শিল্পের জন্য কানাডা অন্যতম। এছাড়া কানাডার সরকার অভিবাসীদের বেকার ভাতাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও আরথিক নিরাপত্তা দেয়। দেশটিতে অভিবাসীদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুপ্তপূর্ণ। কানাডায় অপরাধের পরিমাণও অনেক কম, যে কারণে প্রবাসীরা দেশটিকে পছন্দ করে।
৬. মাল্টা: ইতালির পাশেই অবস্থিত মাত্র ৪ লাখ বাসিন্দার দেশ মাল্টা প্রবাসীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। কারণ এখানে বাস করার অনুমতি পাওয়া অনেক সহজ। তাই অল্প লোকসংখ্যার দক্ষিণ ইউরোপের এই দ্বীপ দেশটিতে প্রচুর অভিবাসী সহজেই প্রবেশ করছে। এছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দরযে সমৃদ্ধ মাল্টাতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সুরক্ষাও অনেক ভালো ।
৭. সুইজারল্যান্ড: অন্যতম ধনী দেশগুলোর একটি সুইজারল্যান্ড বিশ্বে শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত । তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রবাসীদের পছন্দের তালিকায় অন্যতম দেশ এটি। জরিপে অংশ নেওয়া প্রবাসীরা বলেছেন, দেশটিতে অপরাধের হার অনেক কম এবং ধনী দেশ হওয়ায় সুইজারল্যান্ডে আর্থিক নিরাপত্তাও অনেক শক্তিশালী।
৮. নরওয়ে: ইউরোপের দ্বিতীয় জনবহুল রাষ্ট্র নরওয়ে। দেশটিকে অনেক নিরাপদ মনে করেন পরিবার নিয়ে থাকা অভিবাসীরা। বর্তমানে এই দেশটি জাতিসংঘের সবচেয়ে সুখি দেশের তালিকায় এক নম্বরে।
৯. নিউজিল্যান্ড: অসংখ্য ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত নিউজিল্যান্ড প্রবাসীদের কাছে বিশ্বের অন্যতম শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ও আর্থিক উন্নয়নের জন্যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের এই দেশটি প্রবাসীদের শীর্ষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে। জরিপে অংশগ্রহন করা বেশিরভাগ প্রবাসীর মতে, অপরাধের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় থাকায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অনেক উন্নত।
১০. ফিনল্যান্ড: ইউরোপের অন্যতম শান্তির ও উন্নত দেশ ফিনল্যান্ড। দেশটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক বছরের। বর্তমানে আধুনিক স্থাপত্যকলায় বিশ্বে ফিনল্যান্ডের সুনাম রয়েছে। মূলত প্রবাসীরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য এই দেশটিকে বেছে নিয়েছে। নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনসের জরিপে অংশ নেওয়া দশ জনের মধ্যে সাতজন প্রবাসী জানিয়েছে, দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক ভালো।
১১. তাইওয়ান: ৩শ ৯৪ কিলোমিটার বা ২শ ৪৫ মাইলের দেশ তাইওয়ান। চীন এই দ্বীপকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে। ছোট এ দ্বীপে চাকরি ও ব্যবসার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। ফলে দেশটি প্রবাসীদের কাছে খুব জনপ্রিয়। বিশেষ করে ক্যারিয়ারের উন্নতির অনেক সুযোগ থাকায় তাইওয়ান প্রবাসীদের কাছে বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে।
১২. ওমান: আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত ওমান। মরুভূমি ও সুউচ্চ পর্বতমালায় ঘিরে রয়েছে এই দেশটিকে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশেটিতে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কম। যে কারণে প্রচুর প্রবাসী আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বেছে নিচ্ছে এই দেশটিকে। শুধু জীবনযাত্রাই নয়, এই দেশটিতে অপরাধের হারও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। বর্তমানে এই দেশটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কৃষি ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। বলা যায়, মরুময় এই দেশটিকে আজ সবুজ দেশে পরিনত করেছে বাংলাদেশি প্রবাসীরা।
No comments:
Post a Comment