ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ব্রাজিলের জাতীয় দলটি তাদের প্রথম খেলাটি খেলে ১৯১৪ সালে। ব্রাজিলের রিউ দি জানেইরু ও সাঁউ পাউলুদলের মধ্য থেকে নির্বাচিত একটি দল ইংল্যান্ডের এক্সটার সিটি ফুটবল ক্লাবের সাথে একটি খেলায় অংশ নেয়। ফ্লামিনিনেস স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই খেলায় ব্রাজিল ২-০ গোলে জয়ী হয়। ব্রাজিলের পক্ষে দুটো গোল করে অসওয়াল্ড গোমেজ ও ওসমান। অনেকে দাবি করেন যে, এই খেলাটি ৩-৩ গোলে ড্র হয়েছিলো। ভবিষ্যতের গৌরবোজ্জল সাফল্যের তুলনায় শুরুর দিকে দলটির উপস্থিতি ছিলো খুবই নগণ্য। ব্রাজিলীয় ফুটবলে পেশাদারিত্বের অভাবের কারণে একটি শক্তিসম্পন্ন দল গঠন করতে ব্রাজিলীয় ফুটবল ফেডারেশন তখন ব্যর্থ হয়েছিলো।
সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৫৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজিল দল পূর্ণাঙ্গভাবে আত্মপ্রকাশ করে। গেল আসরের মারাকানায় পরাজিত হওয়ার বেদনা ভুলে নিল্টন সাঁতোস, দালমা সাঁতোস, দিদি’র ন্যায় একগুচ্ছ প্রতিভাবান ফুটবলারদেরকে নিয়ে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু, দলটি খুব বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি। কোয়ার্টার-ফাইনালে শীর্ষস্থানীয় হাঙ্গেরি দল ৪-২ ব্যবধানে ব্রাজিলকে পরাজিত করে। এ খেলাটি ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে কদর্যপূর্ণ খেলারূপে বিবেচিত হয় ও অমর্যাদাকরভাবে বার্নের যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়।স্বর্ণযুগ এবং পেলে (১৯৫৮-১৯৭০)
১৯৫৮ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কোচ ভিসেন্তে ফিওলা দলে কিছু কঠোর নিয়ম আরোপ করেন। খেলোয়াড়দের চল্লিশটি ব্যাপার না করার আদেশ একটি তালিকা আকারে দেওয়া হয়। এসব নিয়মের মধ্যে ছিলো মাথায় হ্যাট পরিধান বা ছাতা ব্যবহার করা যাবে না, অফিসিয়াল ড্রেসে থাকা অবস্থায় ধূমপান করা যাবে না, দলের বাইরে থেকে পত্রিকা বা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা যাবে না ইত্যাদি। সেসময় ব্রাজিল ফুটবল দলই ছিলো একমাত্র দল যাদের নিজস্ব একজন মনঃস্তাত্বিক (কারণ ১৯৫০ সালের ফাইনালের দুঃসহ স্মৃতি তখনো কিছু খেলোয়াড়কে মানসিকভাবে অস্থিতিশীল করে রেখেছিলো) ও ডেন্টিস্ট (কারণ জাতিগত কারণে অনেক খেলোয়াড়েরই দাঁতের সমস্যায় ভুগতেন, এর ফলে দাঁতের সংক্রমণের কারণে তাঁদের মাঠের নৈপূণ্যতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতো) ছিলো। সেসময় বাছাইপর্বের খেলাগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য ব্রাজিল দলের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধিকে ইউরোপে পাঠানো হয়েছিলো।ধারাবাহিক সাফল্য (১৯৯৪-২০০২)
১৯৯৪ বিশ্বকাপ
অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, ব্রাজিল দল আন্তর্জাতিক ফুটবলে ১৯৭০ সালের পর দীর্ঘ ২৪টি বছর বিশ্বকাপ জয় করতে পারেনি, এমন কী ফাইনালেও উঠতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে তারা সেই সৌভাগ্য ফিরে আনে। সে সময় দলের আক্রমণভাগে খেলতেন সে সময়ের সেরা ফরোয়ার্ডরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রোমারিও, বেবেতো, দুঙ্গা, তাফারেল, এবং জোরগিনহো। ১৯৯৪ সালেই ব্রাজিল রেকর্ড চতুর্থবারের মতো ফিফা বিশ্বকাপ জয় করে। এই টুর্নামেন্টে ব্রাজিল শুরু থেকেই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে খেলতে থাকে। গ্রুপ পর্ব থেকে উত্তোরণের পর ১৬ দেশের পর্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১-০ তে জয়লাভ করে তাঁরা কোয়ার্টার ফাইনালের ওঠে। সেখানে নেদারল্যান্ডের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ এক খেলায় ৩-২ গোলে জয়লাভ করে সেমিফাইনালের জন্য উত্তীর্ণ হয় (এই খেলাটিকে ঐ টুর্নামেন্টের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলা হিসেবে বিবেচিত হয়)। এছাড়া সুইডেনকে তাঁরা সেমিফাইনালে ১-০ গোলে পরাজিত করে। অতঃপর ফাইনালে একটি চিরচেনা ক্ল্যাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয়—ব্রাজিল বনাম ইতালি। খেলাটি ০-০ গোলে ড্র হওয়ায় ট্রাইবেকারের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারিত হয়। শেষ মুহুর্তে ইতালির আক্রমণভাগের খেলোয়াড় রবের্তো বাজ্জোর শট ক্রসবারের ওপর দিয়ে চলে গেলে, ব্রাজিল চতুর্থবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই সাথে পুণরায় ফিরে আসে বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলের আধিপত্যের যুগ।১৯৯৮ বিশ্বকাপ
ব্রাজিল ১৯৯৮ ফিফা বিশ্বকাপে রানার-আপ হয়। সেমিফাইনালে ব্রাজিল নেদারল্যান্ডের সাথে ড্র করে। এই ম্যাচে রোনালদো এবং প্যাট্রিক ক্লুভার্ট প্রত্যেকেই নিজ নিজ দলের পক্ষে একটি করে গোল করে। ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ৩-০ গোলে হেরে যায়। এই ম্যাচে ব্রাজিলের রক্ষণভাগ দুর্বল ছিল। জিনেদিন জিদান কর্নার কিক থেকে হেডের মাধ্যমে দুই গোল করে। ফাইনাল ম্যাচের কিছু পূর্বেই রোনালদো স্নায়ুরোগে ভুগছিলেন। উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে না পারায় অনেকেই রোনালদোকে প্রথম লাইন-আপে রাখার ব্যাপারে সমালোচনা করেছিলেন।২০০২ বিশ্বকাপ
বাছাই পর্বের মাত্র পাঁচটি খেলা হাতে রেখে ঐসময় বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন নিয়ে ব্রাজিল বিরাট সংশয়ে ছিল। ২০০১ সালে লুইজ ফেলিপে স্কলারি কোচের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম ম্যাচেই ব্রাজিল উরুগুয়ের কাছে ০-১ গোলে হেরে গেলে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল মূলপর্বে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়।বিশ্বকাপের জন্য চূড়ান্ত দল ঘোষণা করার আগে প্রবল জনমত উপেক্ষা করে তিনি বর্ষীয়ান স্ট্রাইকার রোমারিওকে দলে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি রোমারিও নিজেও কান্নাজড়ানো কন্ঠে আবেদন জানালে স্কলারি তা নাকচ করে দেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ব্রাজিলকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল দল হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছিল। কিন্তু একে-একে তুরস্ক, চীন, কোস্টারিকা, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড এবং সেমি-ফাইনালে আবার তুরস্কের বিরুদ্ধে জয় ব্রাজিলকে ফাইনালে পৌঁছে দেয়। ফাইনালে রোনালদো'র জোড়া গোলে ব্রাজিল জার্মানিকে পরাজিত করে পঞ্চমবারের মত বিশ্বকাপ শিরোপো নিজেদের করে নেয়।২০০৬ বিশ্বকাপ পরবর্তী যুগ
১৯৯৪ সালের ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য দুঙ্গাকে ২০০৬ সালের ২৪ জুলাই ব্রাজিলের নতুন কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সহকারী কোচ হিসেবে দুঙ্গা তাঁর প্রাক্তন সহ খেলোয়াড় জোরগিনহোকে বেছে নেন। সেই বছরের আগস্টের ১৬ তারিখ নরওয়ের বিপক্ষে ব্রাজিল খেলা দিয়ে কোচ হিসেবে দুঙ্গার অভিষেক খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। এটিতে ব্রাজিল ১-১ গোলে ড্র করে। কোচ হিসেবে দুঙ্গার দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিলো অপেক্ষাকৃত কঠিন। ৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই খেলায় ব্রাজিল মুখোমুখী হয় তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার। লন্ডনে আর্সেনালের নতুনএমিরেটস স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই খেলায় ব্রাজিল ৩-০ গোলে আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করে। ৫ সেপ্টেম্বর তাঁরা টটেনহ্যাম হটস্পারের হোয়াইট হার্ট মাঠে ওয়েলসকে ২-০ গোলে পরাজিত করে। পরবর্তীতে তাঁরা কুয়েতের ক্লাব আল-কুয়েতকে ৪-০, ইকুয়েডরকে ২-১, ও সুইজারল্যান্ডকে ২-১ গোলে পরাজিত করে।কোচ হিসেবে প্রথম পরাজয়ের মুখোমুখি হন ২০০৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। পর্তুগালের বিপক্ষে এক ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ব্রাজিল পরাজিত হয়। সে সময় পর্তুগালের কোচ ছিলেন ব্রাজিলের সাবেক বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুইজ ফেলিপে স্কলারি। পরবর্তীতে সুইডেনে ব্রাজিল তাদের প্রথম পরাজয় থেকে ঘুরে দাঁড়ায় ও মার্চের ২৪ ও ২৭ তারিখ যথাক্রমে চিলি (৪-০) ও ঘানাকে (১-০) পরাজিত করে।২০০৯ ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ
২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ফিফা কনফেডারেশন্স কাপে ব্রাজিল শিরোপা জয় করে। এই টুর্নামেন্টে ব্রাজিলের শুরুটা খুব একটা স্বাচ্ছন্দপূর্ণ ছিলো না। প্রথম খেলায় তাঁরা মিশরেরসাথে হারতে হারতে ৪-৩ গোলে জিতে যায়। খেলার শেষ মিনিটে এসে মিশরের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে একটি গোল করার মাধ্যমে ব্রাজিলের এই জয় আসে। ব্রাজিলের বিপক্ষে আফ্রিকার কোনো ফুটবল দলের এক ম্যাচে তিন গোল করার ঘটনা সেটিই ছিলো প্রথম। পরবর্তীতে অবশ্য দলটি খুব ভালোভাবে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে। উভয়কেই ব্রাজিল ৩-০ গোলে হারায়। এছাড়া ব্রাজিল সেমিফাইনালে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরাজিত করার পর, ফাইনালে তারা পুনারায় যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হয়। উত্তেজনাপূর্ণ এই ফাইনালের প্রথমার্ধে ব্রাজিল ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকলেও, দ্বিতীয়ার্ধে তারা পুরোপুরিভাবে খেলায় ফিরে আসে ও দুইটি গোলই পরিশোধ করে। পরবর্তীতে খেলা শেষের ছয় মিনিট আগে লুসিও শিরোপাজয়ী গোলের সুবাদে ব্রাজিল ৩-২ গোলে তাদের তৃতীয় ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জয় করে। এই টুর্নামেন্টে প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হন ব্রাজিলের কাকা ও সবচেয়ে বেশি গোল করেন ব্রাজিলের-ই লুইস ফ্যাবিয়ানো। তিনি পাঁচ ম্যাচে মোট পাঁচটি গোল করেন।২০১০ ফিফা বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব
২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রোজারিওতে আর্জেন্টিনার নিজেদের মাঠে, আর্জেন্টিনাকে ৩-১ গোলে পরাজিত করার মাধ্যমে ব্রাজিল ২০১০ সালের ফিফা বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে থেকে মূলপর্বে উত্তীর্ণ হয়।২০১০ ফিফা বিশ্বকাপ
২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের লটারিতে ব্রাজিল জি গ্রুপে স্থান পায়। অনেকের মতে এটিই হচ্ছে এ বিশ্বকাপের গ্রুপ অফ ডেথ। এই গ্রুপের হয়ে সেলেকাওরা তাদের প্রথম খেলাটি খেলে ২০১০ সালের ১৫ জুন, উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে। এরপর ২০ জুন তারা খেলে কোত দিভোয়ারের বিরুদ্ধে, এবং গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ২৫ জুন তারা খেলে অপর শক্তিশালী দল পর্তুগালের বিরুদ্ধে।
ইতিহাস
Friday, December 18, 2015
ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দল
ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দল হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ব্রাজিলের প্রতিনিধিত্বকারী ফুটবল দল। এই দলটিকে নিয়ন্ত্রণে করে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (সিবিএফ)। ১৯২৩ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা’র সদস্য হয়। এরপূর্বেই ১৯১৬ সাল থেকে দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল কনফেডারেশন কনমেবলের অন্যতম সদস্য দেশ। ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফলতম দলটি হচ্ছে ব্রাজিল। এ পর্যন্ত দলটি পাঁচবার (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪ ও ২০০২) বিশ্বকাপ জয় করেছে যা একটি রেকর্ড। ফুটবলের ব্যাপারে একটি সাধারণ উক্তি হচ্ছে: ‘The English invented it, the Brazilians perfected it.’, অর্থাৎ, ‘ইংল্যান্ডের আবিষ্কার, আর ব্রাজিলের পরিপূর্ণতা দান’।ফিফা’র বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে বর্তমানে দেশটির অবস্থান ষষ্ট। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই দলটি শীর্ষস্থানে ছিল। এছাড়া এলো’র রেটিং অনুসারে ব্রাজিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর ফুটবল জাতি। এখন পর্যন্ত ব্রাজিল-ই একমাত্র দল যারা বিশ্বকাপের সবগুলো আসরেই অংশগ্রহণ করেছে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)



No comments:
Post a Comment