Social Icons

Tuesday, December 22, 2015

মার্কিন মুসলিম : ধর্মপরিচয়ই যেখানে প্রধান সমস্যা

ক্যালিফোর্নিয়ার নাগরিক মির্ভেত জুদেহ প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকে একটা অদ্ভুত কাজ করতে শুরু করেছেন। এমনিতে তিনি নিয়মিত হিজাব পরেন, কিন্তু সেই হিজাব যাতে লোকে দেখতে না পারে, সেজন্য গত দুই সপ্তাহ যাবত একটা মাথা ঢাকা সোয়েটার দিয়ে সেটা ঢেকে রাখছেন। সন্তানদের নিয়ে গাড়িতে করে বাইরে বের হলে এই কাজটা ইদানিং তাকে করতে হচ্ছে। শুধু তাই না, এর কারণ হিসেবে ছেলেমেয়েদের বলতে হচ্ছে যে, হিজাব দেখতে পেলে লোকে বুঝে ফেলবে যে তিনি মুসলিম এবং কেউ হয়তো তাকে আঘাত করবে।       ৩৯ বছর বয়সী ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসী জুদেহ বলেছেন, ‘নিজের সন্তানদের সাথে এই জাতীয় কথা বলতে তার কষ্ট হয়। নিজের ধর্মের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে হিজাব পরার যে সিদ্ধান্তটি তিনি নিয়েছিলেন, সেটা যে তাকে এবং তার পরিবারকে বিপদে ফেলে দিতে পারে সেই কথা তিনি ছেলেমেয়েদের কিভাবে বলেন।’  গত ডিসেম্বরের ২ তারিখে ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নারডিনোতে জঙ্গি সংগঠন আইএসের আদর্শে অনুপ্রাণিত এক মুসলমান দম্পতি ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর ক্যালিফোর্নিয়াতে মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানকার মুসলিম-আমেরিকান মানুষেরা ভুগছেন পরিচয় সঙ্কটে এবং অনেক মুসলমান বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীতির মুখে পড়েছেন।          যেমন মির্ভেত জুদেহ বলেছেন, তিনি তার সন্তানদেরকে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে মুসলিম হওয়ার কারণে তাদের কাজকর্ম মানুষ এখন অনেক বেশি করে খুঁটিয়ে দেখবে।   তিনি তার ১৮ বছরের ছেলেকে শেখাতে বাধ্য হয়েছেন যে, ছেলে যেন কোনো অবস্থাতেই স্কুলে গিয়ে ‘ব্লো আপ’ শব্দটি মুখ দিয়ে উচ্চারণ না করে এবং বন্ধুদের সাথে এমনকি খেলার ছলেও যেন পিস্তল নিয়ে খেলা না করে। ছেলে যখন তাকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করে, ‘মানুষ কি তাকে এবং তার পরিবারকে ঘৃণা করে কি না?’, তখন সেই প্রশ্নের জবাব দেয়াটা জুদেহর জন্য কঠিন হয়ে যায়, কারণ হিজাব পরার জন্য তাকেও মানুষের অনেক হুমকি ও গঞ্জনা সইতে হয়েছে।          এই জাতীয় সমস্যা মূলত শুরু হয়েছিল যখন ইসলামিক স্টেটের বন্দুকধারীরা এবং আত্মঘাতী বোমারুরা নভেম্বরের ১৩ তারিখে প্যারিস শহরে ১৩০ জন মানুষকে খুন করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এমনকি প্যারিস হামলার আগে থেকেও মুসলিম বিদ্বেষী চিন্তা-ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমেই বাড়ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থীদের নানান বক্তব্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন প্রার্থী বেন কার্সন যেমন ব্যাঙ্গ করে বলেছেন মুসলিমদের প্রেসিডেন্সীর যোগ্যতা নেই, তেমনি কোটিপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পও সম্প্রতি দাবি করেছেন মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার।                  ফ্লোরিডার সাবেক গভর্নর ও প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী জেব বুশ সিরিয়ার শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সমস্যা নিয়ে বলেছেন, ‘সিরিয়ার শরণার্থীদের মধ্যে যারা নিজেদেরকে খ্রিস্টান বলে প্রমাণ করতে পারবেন শুধুমাত্র তাদেরকেই যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেয়া হোক।’ যদিও যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে পালানো লাখ লাখ শরণার্থীদের মধ্যে অতি সামান্য পরিমাণ গিয়ে জড় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায়।             অনেক মুসলিম পরিবার ভয় পাচ্ছেন যে এই বিদ্বেষের কারণে হয়তো তাদের প্রতি অনেক ঘৃণামূলক আচরণ করা হবে। যেমন ডিসেম্বরের ৭ তারিখে ফিলাডেলফিয়ার একটি মসজিদের দরজার সামনে কেউ একজন ফেলে রেখে এসেছে একটি শূকরের কাটা মাথা। এই খবর সবগুলো জাতীয় দৈনিকের হেডলাইনে এসেছিল। শূকরের মাংস কিংবা এর থেকে তৈরি অন্য যেকোনো দ্রব্য ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম বা নিষিদ্ধ। আবার এমন কিছু ঘটনা আছে যেগুলো খবরে প্রকাশিত হয় না কিংবা মানুষ জানেনা। যেমন, ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি পার্কে প্রার্থনারত কিছু মুসলিমদের উপর গরম কফি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন একজন নারী। এই জাতীয় ঘটনার খবর ও হিসাব রাখেন আমেরিকান-মুসলিম কাউন্সিল। তাদের কাজ হচ্ছে আমেরিকান-ইসলামিক সম্পর্কের খোঁজখবর রাখা। তারা জানিয়েছেন, মুসলিমদের উপর ঘৃণামূলক অপরাধের মাত্রা বিগত ছয় বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা মতে, নভেম্বরের ১৩ তারিখের প্যারিস হামলার পর থেকে কমপক্ষে ৩৭টি মুসলিম বিদ্বেষী ঘৃণামূলক অপরাধ সংগঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তার মধ্যে ১১টি ঘটেছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নারডিনো হামলার পরের সপ্তাহে। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির এই গবেষণার মূল সুত্র ছিল মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশানের তথ্য।          যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩৪ লাখ মুসলমানদের অনেকেই এটা চিন্তা করে আতংকিত যে, এই জাতীয় ঘটনা হয়তো আরো ভয়ানক কুৎসিত রূপ ধারণ করবে খুব শিগগিরি। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়নের লড়াইয়ে। মুসলিমদের প্রতি রাগ, ঘৃণা এবং ধর্মান্ধতাকে প্রার্থীরা যে ভাবে ব্যবহার করছেন তাতে সেই আশঙ্কা খুবই সংগত।     যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ মুসলিমরা বলেছেন, চরমপন্থিদের সাথে তাদের পার্থক্য এবং নিজেদের মার্কিন নাগরিক প্রমাণ করার জন্য তারা প্রায়ই কিছু একটা করার কথা ভাবেন। কিন্তু কি করা যেতে পারে?  যেমন, ২৭ বছর বয়সী সারা হাদ্দাদ মনে করেন সবাইকে এটাও বোঝানো দরকার যে, আমরাও তাদেরই মত একজন, আমরাও ফুটবল খেলা দেখি কিংবা ভালোবাসি পপ-রক সঙ্গীত। নর্থ ক্যারোলিনার অধিবাসী সারা একজন ক্যান্সার গবেষক এবং তার ৬ মাস বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। জনপ্রিয় টেক্সাস প্রফেশনাল ফুটবল টিমকে উদ্দেশ করে সারা বলেন, ‘যেমন ডালাস কাউবয়দেরকে আমি ভালোবাসি কিংবা আমি আমার পরিবারের সাথে থাঙ্কসগিভিং অনুষ্ঠান পালন করেছি।’ এই কাজগুলো করলে নিজিকে খুব বেশিমাত্রায় আমেরিকান হিসেবে জাহির করা যায়। কিন্তু সবশেষে এটাও  বলতে হয় যে, ‘আমেরিকান হওয়া বলতে আসলে কি বোঝায়?’            সারা আরো বলেছেন যে, তিনি জানেন না মেয়ে বড় হলে তার কাছে ইসলামী জঙ্গিবাদ কিংবা মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য ঠিক কিভাবে বুঝিয়ে বলবেন। এটাকে সারা তুলনা করেছেন সান্তা ক্লজ ঘটনার সাথে। যেমন অনেক বাবা-মা কাল্পনিক সান্তা ক্লজের ব্যপারে তাদের সন্তানদের জানাতে চান না। সান্তা ক্লজ যে বাস্তবে নেই সেটা যতদিন পর্যন্ত ছেলেমেয়দের না জানিয়ে তাদের মনের পবিত্রতা রক্ষা করা যায় সেই চেষ্টা করেন। সারাও এটা করার চেষ্টা করবেন।           যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখের বিধ্বংসী হামলার কথা উল্লেখ করে সারা বলেন, ‘৯/১১ এর ভয়াবহতা আমার শৈশবকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাইনা যে আগামী পাঁচ বছরে পরিস্থিতি আবার সেই রকম ভয়াবহ হবে।’ বাল্টিমোরের আরেক অধিবাসী ২৯ বছর বয়সী আরিফ খান বলেছেন, তিনিও চান না তার ছেলের শৈশব গোলাগুলি এবং হানাহানির আলাপ আলোচনায় ভরে থাকুক।   তিনি বলেছেন, তার স্ত্রীও হিজাব পরেন কিন্তু ঘরের বাইরে যেতে হলে এখন তাদের সতর্ক থাকতে হয়। রাস্তায় তাদেরকে কেউ অনুসরণ করছে কিনা বা বাইরে কোথাও প্রার্থনা করতে হলে তাদেরকে খুব সাবধানে জায়গা নির্বাচন করতে হয়। তিনি ও তার স্ত্রী চান তাদের ১ মাস বয়সী ছেলে যেন বড় হয়ে আরো বেশি সতর্ক হয়। একইসাথে তারা ছেলেকে মুসলিম ও আমেরিকান মূল্যবোধও শিক্ষা দিতে চান।        খান বলেন, ‘আমরা চাই না আমার ছেলে সবার আগে জানুক যে কিভাবে আমরা গৎবাঁধা খারাপ জিনিশগুলো নিয়ে একে অন্যের সাথে যুদ্ধ করি। আমি চাই সে আগে জানুক প্রকৃত ইসলামিক আমেরিকান মূল্যবোধ।’ জিনান আল মারায়াতি নামের ১৫ বছর বয়সী আরেক মুসলিম কিশোরী পড়াশুনা করে লস এঞ্জেলেসের ক্যাথোলিক স্কুলে। সে বলেছে, ক্লাসে যখন ইসলামিক স্টেট নিয়ে আলোচনা শুরু হয় তখন নিজের ধর্মকে রক্ষা করার জন্য সে চাপের মুখে পড়ে যায়। সে যদিও শিক্ষক এবং সহ পাঠীদের সব প্রশ্নের উত্তর হাশিমুখে দেয়, কিন্তু তবু আমেরিকান বন্ধুদের সাথে ঘোরার সময় তাকে তার মুসলিম ও ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যের কথা চেপে যেতে হয়।   মারায়াতি বলেছে, ‘আমার কাছে মনে হয় আমার দুটো পরিচয়: একটা মুসলমান, আরেকটা আমেরিকান। মুসলিম বন্ধুদের সাথে থাকার সময় মনে হয় আমি বোধ হয় এখনো ঠিকমত মুসলিম হতে পারিনি, আবার অমুসলিম বন্ধুদের সাথে যখন থাকি তখন বাধ্য হয়ে অনেক জিনিশ চেপে যায়, যাতে কেউ অস্বস্তিতে না পড়ে।’ 

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates