Social Icons

Thursday, October 27, 2016

কাবা ও হজ নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র

পবিত্র কাবা শরিফ পৃথিবীতে আল্লাহর জীবন্ত নিদর্শন। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই আল্লাহ তাআলা কাবাকে তাঁর মনোনীত বান্দাদের মিলনমেলা হিসেবে কবুল করেছেন। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি এই কাবাকে কেন্দ্র করেই। কাবাগৃহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও সুপ্রাচীন ঘর। কোরআনের ভাষায়, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় (মক্কা নগরীতে) অবস্থিত।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬)
কাবা শরিফ গোটা বিশ্বের স্তম্ভস্বরূপ, বিশ্বের ব্যবস্থাপনা ও বাইতুল্লাহর মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ সম্মানিত গৃহ কাবাকে মানুষের স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৯৭)
ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে কাবাকে কেন্দ্র করে। নামাজ, হজ, কোরবানি, পশু জবাই, মৃতের দাফনসহ অনেক ইবাদত আদায় করতে হয় কাবার দিকে ফিরে। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, কাবাগৃহে এক রাকাত নামাজ আদায় করলে এক লাখ রাকাত নামাজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। কাবা শরিফের এই বিশেষ মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কথা বিবেচনা করে ইসলাম কাবার দিকে মুখ বা পিঠ দিয়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে বসবে, সে যেন কাবাকে সামনে বা পেছনে না রাখে।’ (মুসলিম শরিফ)
পবিত্র কাবা বিশ্ব মুমিনের সম্মিলনস্থল, ঐক্যের প্রতীক, ভালোবাসার স্পন্দন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি কাবাঘরকে মানুষের প্রত্যাবর্তনস্থল ও শান্তির আধার করেছি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৫)
কাবার সীমানায় প্রবেশকারী জীবজন্তুও নিরাপদ জীবন লাভ করে। পবিত্র কাবা অফুরন্ত কল্যাণ ও বরকতের প্রতীক। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম নির্মিত ঘর বাক্কায় অবস্থিত। এ ঘর বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়েতস্বরূপ। এতে রয়েছে বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন। মাকামে ইবরাহিম তার একটি। যে ব্যক্তি এর ভেতরে প্রবেশ করে, সে নিরাপত্তা লাভ করে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬-৯৭)
সর্বপ্রথম কাবা নির্মাণ করেন ফেরেশতারা। বেহেশত থেকে দুনিয়ায় আগমনের পর হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর অনুরোধে সেটাকেই তাঁদের ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করে দেন আল্লাহ তাআলা। নুহ (আ.)-এর সময়কার মহাপ্লাবনে কাবাঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আল্লাহর নির্দেশে কাবা শরিফ পুনর্নির্মাণ করেন হজরত ইবরাহিম  ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.)। এর পর থেকে কখনো বন্ধ থাকেনি কাবাঘরের জিয়ারত। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আমলে এ আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণতা পায়। নবুয়ত লাভের ২২ বছর পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে হজ পালন করেন রাসুল (সা.)। তাঁর দেখানো নিয়ম অনুসারেই প্রতিবছর শান্তিপূর্ণভাবে হজ পালন করেন লাখ লাখ মুসলমান। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মুসলমানদের হজ থেকে বিমুখ করার জন্য নতুন নতুন কাবা নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দেশে কাবার আদলে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তাওয়াফ, সাঈ ও হজের বিভিন্ন বিধান পালনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নব্য আবরাহাদের উত্থান
পাকিস্তানের কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী পাকিস্তান, তিউনিসিয়া, কেনিয়াসহ কয়েকটি মুসলিম দেশে নতুন কাবা নির্মাণ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে যে মক্কায় হজ পালনে এটা সহায়ক হবে এবং এর মাধ্যমে হজ প্র্যাকটিস করা যাবে। কিন্তু তিউনিসিয়ার ব্যাপারে এ খবর পাওয়া গেছে যে সেখানে একটি দলের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা মনে করে রুগ্ণ-পীড়িত লোকদের জন্য মক্কায় না গিয়ে এখানে ‘হজ’ আদায় করলে হজ আদায় হয়ে যাবে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ‘জিকরি’ নামের ফেরকা বের হয়েছে। তারা সরাসরিই এ দাবি করে যে হজের জন্য মক্কায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজ দেশেই হজ করা যায়! সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া কিছু ভিডিওতে দেখা যায় যে বিভ্রান্ত হয়ে বহু লোক সেসব বানানো কাবায় কথিত হজও পালন করছে। (http://javedch.com/latest-news/2016/10/09/194572)
এই নতুন হজ ফিতনায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের নামও। ঢাকার দোহারে ‘লটাখোলা কুমার বাড়ী কাদরীয়া পাক দরবার শরীফে’ খোলা হয়েছে বিশ্ব ধ্যান মঞ্জিল। এখানেই মাত্র সাড়ে সাত শ টাকায় হজ পালনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্প্রতি এটা নিয়ে বেসরকারি চ্যানেল নিউজটোয়েন্টিফোর বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরে। পরে প্রশাসনের টনক নড়ে। কিন্তু আশ্চর্য হলো, সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই সময়ে নতুন কাবাগৃহ নির্মাণ নিশ্চয়ই কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয়। সন্দেহ নেই যে এর পেছনে রয়েছে কোনো আন্তর্জাতিক চক্র। এদিকে গত বছর মিনা দুর্ঘটনায় বহু হজযাত্রী হতাহতের ঘটনায় সৌদি সরকার ইরানকে দায়ী করে। আর ইরানও হজ ব্যবস্থাপনায় ভাগ পেতে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। এর জের ধরে এ বছর সৌদিতে ইরানিদের হজ নিষিদ্ধ করা হয়। তবে কে বা কারা এই নতুন ধারার হজ আবিষ্কারে জড়িত, এ ব্যাপারে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে মানুষকে মক্কা ও কাবাবিমুখ করার জন্য অতীতেও অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেসব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
মহানবী (সা.)-এর জন্মের বছর ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকা সাম্রাজ্যের নাজ্জাশি বাদশাহর অধীনে ইয়েমেনের গভর্নর ছিলেন আবরাহা বিন সবাহ। তিনি চিন্তা করলেন যে আরবদের মক্কায় হজ বাদ দিয়ে ইয়েমেনে হজ করাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাবার আদলে একটি ঘর নির্মাণ করেন। এর নাম ছিল ‘কুল্লাইস’। সর্বত্র ঘোষণা করা হলো যে এ বছর থেকে হজ কাবাগৃহের বদলে এখানে হবে। তাঁর এই ঘোষণা সর্বত্র দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। কুরাইশরা রাগে ফেটে পড়ল। কথিত আছে, তাদের কেউ একজন এসে ওই জাঁকজমকপূর্ণ গির্জায় গোপনে ঢুকে পায়খানা করে যায়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, কুরাইশদের একদল যুবক ওই গির্জায় ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়, যাতে গির্জা পুড়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এর প্রতিশোধে কাবা শরিফ ধ্বংস করার জন্য আবরাহা বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করেন। কোনো বর্ণনায় ২০ হাজার এবং কোনো বর্ণনায় ৬০ হাজার সেনার কথা এসেছে। ওই বাহিনীর সঙ্গে নাজ্জাশির পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশালবপু হস্তিবাহিনী পাঠানো হয়, যার নেতৃত্বে ছিল মাহমুদ নামের একটি হাতি। হস্তিবাহিনীর সংখ্যা কেউ বলেছেন একটি, কেউ বলেছেন দুটি, আটটি বা ১২টি বা তারও বেশি। তবে ‘মাহমুদ’ ছিল এদের নেতা। বাকিরা মাহমুদের অনুগামী। এদের নেওয়া হয়েছিল এ জন্য যে লোহার শিকলের এক প্রান্ত কাবার দেয়ালে বেঁধে অন্য প্রান্ত হাতির ঘাড়ে বাঁধা হবে। তারপর হাতিকে হাঁকিয়ে দেওয়া হবে, যাতে পুরো কাবাগৃহ একসঙ্গে উপড়ে পড়ে। অতঃপর আবরাহা যখন মক্কা অভিমুখে রওনা হওয়ার উদ্যোগ নেন, হাতিকে মক্কার দিকে হাঁকাতে চেষ্টা করেন, তখন হাতি বসে পড়ে। তারপর শতচেষ্টা করেও হাতিকে মক্কামুখী করা যায়নি। অথচ ইয়েমেনমুখী করা হলেই হাতি দৌড় দেয়। মক্কামুখী করলেই বসে পড়ে। এরই মধ্যে সাগরের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অচেনা পাখি আসতে শুরু করে, যাদের সবার মুখে একটি এবং দুই পায়ে দুটি কঙ্কর ছিল, যা ডাল ও গমের মতো। এই কঙ্কর যার মাথায় পড়েছে, সে ধ্বংস হয়েছে। কিছু আঘাতপ্রাপ্তকে মরতে দেখে বাকি সবাই দিগ্বিদিক ছুটে পালাতে শুরু করে। ইবনু ইসহাক বলেন, আবরাহা বাহিনী মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়েমেন পর্যন্ত পথে পথে মরতে মরতে যায়। আবরাহা তাঁর প্রিয় রাজধানী ছানআ শহরে পৌঁছে লোকদের কাছে আল্লাহর আজাবের ঘটনা বলার পর মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় তাঁর বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে যায়। (ইবনে কাসির ও তাফসিরে মুনির)
মহানবী (সা.)-এর মদিনার জীবনেও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। মুসলমানদের বিভক্ত করার জন্য কাবা নির্মাণ করা না হলেও মদিনায় মসজিদে কোবার পরিবর্তে একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা মসজিদে কোবার সন্নিকটে এক ইবাদতখানা বা উপাসনালয় নির্মাণ করে। ১২ জন মুনাফিক খ্রিস্টান পাদ্রি আবু আমেরের পরামর্শে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই ইবাদতখানা নির্মাণ করে। এই ইবাদতখানা নির্মাণের চারটি উদ্দেশ্য কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : এক. ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতিসাধন। দুই. কুফরির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। তিন. মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। চার. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারীদের জন্য ঘাঁটি তৈরি করা। ইতিহাসে এই মসজিদকে ‘মসজিদে জেরার’ বা ক্ষতিসাধনের মসজিদ বলা হয়। মসজিদে জেরারের সংজ্ঞা হলো, যে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে লোকদেখানোর জন্য, লৌকিকতা প্রদর্শনের জন্য বা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কিংবা অপবিত্র ও অবৈধ অর্থে। শরিয়ত মতে তা মসজিদে জেরারের অন্তর্ভুক্ত। (মাদারেকুত তানজিল : ২/১১১)
তবে হ্যাঁ, স্বাভাবিক নিয়ম মেনে, ওয়াক্ফ করে এক মসজিদের পাশে অন্য মসজিদ নির্মাণ করা হলে সেখানে নামাজ আদায় বৈধ। (তানবিরুল আবসার : ৪/৩৫১-৩৫২)
শুধু হজ বা কাবা নয়, বিভিন্ন ইবাদতখানা নাম দিয়ে মুসলমানদের মসজিদবিমুখ করার অপতত্পরতাও যুগে যুগে ছিল, এখনো আছে। কথিত বহু পীর-ফকির মসজিদের পরিবর্তে নিজস্ব খানকায় মুরিদদের উপাসনা বা ধ্যান করতে উৎসাহী করে। আহমদিয়া জামাতের লোকেরাও নিজস্ব ইবাদতখানায় প্রার্থনা করে থাকে। মসজিদ, হজ ও কাবাবিরোধী এই ভয়াবহ ফিতনা থেকে নিস্তার পায়নি বাংলাদেশও। এমন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের সজাগ, সতর্ক ও হুঁশিয়ার হওয়ার বিকল্প নেই।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates