সমসাময়িক বিশ্ব ঘটনাবলির দিকে যিনিই তাকাবেন তিনিই লক্ষ করবেন, পেশিশক্তির ওপরে যুক্তির প্রাধান্য বিরাজ করছে না, আমাদের মূল্যবোধ ইতোমধ্যে ক্ষয় পেতে শুরু করেছে, আর আমাদের এমন কোনো নেতা নেই যার ওপর আমরা ভরসা করতে পারি। আমরা সঙ্কটের মধ্যে আছি। বর্তমান পরিস্থিতি একজন লোকের কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনি এই গানটি লিখেছিলেন ‘Where are all the flowers gone, in an English country garden? ’ এই লোকটি যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে উনি আর একটি গান গাইতেন, ‘Where have all the values and valor gone? ’ ইতিহাসে এর আগে কখনো একজন আদর্শ নেতার সঙ্কট এত প্রকটভাবে অনুভূত হয়নি। যেমনটি আজ দেখা দিয়েছে। এ যুগের চাহিদা একজন নেতার যিনি সমগ্র মানব সম্প্রদায়ের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হতে পারেন। যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এ ধরনের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বকে চিহ্নিত করা এবং ছাত্রছাত্রীদের এসব ব্যক্তিত্বের জীবন ও শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করা। মানবজাতি সবসময় এমন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের সন্ধানে রয়েছে এবং বিভিন্ন সমাজ এ উদ্দেশ্যে তাদের চিহ্নিত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো- এই ব্যক্তিরা কি সত্যিই সময়ের বিচারে উত্তীর্ণ হয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে ওই সব ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা যায়, যাদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে উচ্চমর্যাদা দেয়া হয়েছে। যেমন- জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, মাও সেতুং, মহাত্মা গান্ধী এবং তাদের মতো অন্যান্য। তাদের চরিত্রের বিস্ময়কর গুণাবলির জন্য মানুষ তাদের স্মরণ করে, কিন্তু যদি কেউ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, গতিশীল নেতৃত্ব, চরিত্রের সাহসিকতা, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা এবং স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য, কৃতজ্ঞতা প্রভৃতি দিক বিবেচনা করে তাহলে বলা যাবে না যে, এসব মহৎ লোক যুগের সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তারা কেবল একটি বিশেষ সময়ের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ স্যার উইনস্টন চার্চিলের কথা বলা যায়। মানুষ আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে কী করে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং তাদের মনোবল চাঙ্গা করে রেখেছিলেন। এর পরও যখন একই ব্যক্তি চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই নির্বাচনে প্রার্থী হলেন, তিনি তাতে হেরে গেলেন! জনগণ ব্যাপারটি এভাবে বিচার করল : চার্চিল হলেন যুদ্ধকালীন নেতা, শান্তিকালীন নেতা নন। এভাবে ব্রিটিশদের কাছে চার্চিল একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন একটা বিশেষ সময়ের জন্য, সব সময়ের জন্য নয়। এবার ধরা যাক, মাও সেতুংয়ের কথা। কে না জানে তিনি চীনের মূল ভূখণ্ডে কত বড় সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন? কিন্তু ইতিহাসের কী পরিহাস! মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পর ‘দ্য গ্যাং অব ফোর’, যারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে জননন্দিত হয়েছিলেন, তাদেরকে গা-ঢাকা দিতে হয়েছিল। এমনকি মাও সে তুংয়ের স্ত্রীর জীবনেও নেমে এসেছিল বিপর্যয়। আবারো আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আগের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্ব পরবর্তী সময়ে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করা হলো না।
বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ অবদানের জন্য নেলসন ম্যান্ডেলাকে একজন অবিস্মরণীয় নেতা মনে করা হয়। কিন্তু তার জীবনের কিছু দিক, যা একান্তই তার ব্যক্তিগত, তার সময়ের অনেক লোকের পছন্দ নয়। তাই এ কথা সুস্পষ্ট যে এমন কোনো নেতা পাওয়া মুশকিল, যিনি সর্বযুগে সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। যুগে যুগে অনেক ধার্মিক ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন দেশে এসেছেন। তাদের চরিত্র ছিল বিতর্কের ঊর্ধ্বে, তাদের সততা ছিল দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেননি। মানুষ চায় এমন আদর্শ ব্যক্তিত্ব, যিনি রক্তমাংসে গড়া, যিনি সত্য কথা বলেন, যিনি হিংসাবিদ্বেষের ঊর্ধ্বে, যিনি মানুষকে বর্ণ, ধর্ম ও বিশ্বাস নির্বিশেষে ভালোবাসেন এবং যিনি মানুষকে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ সব কাজে নেতৃত্ব দিতে পারেন।
এ ধরনের আদর্শ ব্যক্তিত্ব কি পৃথিবীতে এসেছিলেন? হ্যাঁ, এসেছিলেন এবং তাঁর নাম হজরত মুহাম্মাদ সা:। পবিত্র কুরআনের ২১ নম্বর সূরার ১২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তাঁকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য পাঠানো হয়েছে, কোনো বিশেষ মানবগোত্রের জন্য নয়। তাঁর কাছে যে মহাগ্রন্থ অবতীর্ণ করা হয়েছে তা-ও সর্বজনীন এবং সমগ্র মানবসম্প্রদায়ের জন্য। পবিত্র কুরআনে ৩৩ নম্বর সূরার ২১ নম্বর আয়াতে আরো বলা হয়েছে, আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর যার বিশ্বাস রয়েছে এবং যে আল্লাহর প্রশংসায় মশগুল থাকে, সে রাসূলুল্লাহ সা:-এর মধ্যে জীবন পরিচালনার একটি সুন্দর আদর্শ খুঁজে পাবে। রাসূলুল্লাহ সা:-কে যে সমগ্র মানবজাতির অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, তা তাঁর সব কথায় ও কাজে সুস্পষ্ট। শুধু তা-ই নয়, এ কথা ও কাজগুলোকে যদি ছাত্রদের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা তাদের চরিত্র গঠনে বিশেষ অবদান রাখবে। হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন একাধারে একজন আদর্শ পিতা, একজন আদর্শ স্বামী, একজন আদর্শ যোদ্ধা, একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ও একজন আদর্শ ধর্মপ্রচারক। তাঁর জীবন ও চরিত্র ইতিহাসে এত স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, তাঁর কথা ও কাজের বিবরণ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
পবিত্র কুরআনের আদর্শের তিনি ছিলেন জীবন্ত নিদর্শন এবং তাঁকে অনুসরণ করে যে কেউ সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে মানবতার সেবা করতে পারে। নবীজির একটি বড় আদর্শ, যা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে সব ছাত্রকে জানানো উচিত, তা হলো অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে তাঁর ব্যবহার। যদিও পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ইসলামই একমাত্র জীবনবিধান (দ্বীন)। মুসলমানদের বলা হয়েছে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে খারাপ ভাষা ব্যবহার না করতে, যাতে তারা আল্লাহ সম্পর্কে কুমন্তব্য করার সুযোগ না পায়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি মুসলমানদের আচরণবিধি কী হবে, তা হজরত মুহাম্মাদ সা: তাঁর নিজের জীবনে দেখিয়ে গেছেন। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর যে রাষ্ট্র তিনি গঠন করেছিলেন তার ভিত্তি কী ছিল? এটাই ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’, পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র, সংবিধান। এই গঠনতন্ত্রের একটি ধারা ছিল- বিভিন্ন ধর্মের লোক নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে এবং কেউ অন্যের ধর্ম পালনের বিষয়ে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। এটা শুধুই একটা ‘ধারা’ ছিল না, এই ধারাটি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে এত সুস্পষ্ট উদাহরণ থাকার পরও কোনো মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কি? এ ছাড়া পবিত্র কুরআনে বারবার জোর দিয়ে বলা হয়েছে, মানবসম্প্রদায় এক ও অভিন্ন জাতি। তাই যদি কোনো মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক বলা হয়, তাহলে তার এটা গ্রহণ করা উচিত এবং বলা উচিত যে তার সম্প্রদায় সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে নিয়ে গঠিত। ধ্যানধারণা ও কাজে গোষ্ঠী-মানসিকতার প্রতিফলন ঘটানো কোনো মুসলমানের পক্ষে অসম্ভব। বস্তুত যে কেউ পবিত্র কুরআন পাঠ করেছেন এবং হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর জীবনী পাঠ করেছেন, তিনি অবিলম্বে এই উপসংহারে পৌঁছবেন যে ইসলাম ও সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি থাকতে পারে না। একমাত্র সেই সমাজেই সাম্প্রদায়িকতা বিরাজ করতে পারে যেখানে ইসলাম যথাযথভাবে পালিত হয় না, যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার নেই, যেখানে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা নেই। ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটির বর্তমান সময়ের অর্থে একজন মুসলমান কী করে সাম্প্রদায়িক হতে পারে, যখন সমগ্র মানবজাতিকেই ইসলামে এক জাতি আখ্যায়িত করা হয়েছে?
এ কথাটি ছাত্রদের বোঝাতে হবে যে, বর্তমান সময়ে যদি কেউ একজন আদর্শ শিক্ষক, একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক, একজন আদর্শ ধর্মপ্রচারক, একজন আদর্শ সমাজসংস্কারক এবং একজন মানবতাবাদীকে খুঁজতে চায় তাহলে তার অনুসন্ধান তাকে নিয়ে যাবে হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর কাছে। তিনি বুঝতে পারবেন যেসব মানুষের জন্য এবং মানুষের সব কর্মের জন্য নবীজি মানবজাতির আদর্শ- সর্বকালের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এরূপ চিহ্নিতকরণ শুধু মুসলমানই করবে না, বরং যেকোনো ধর্মের যেকোনো বিবেকবান লোকই এটা করবেন।
জর্জ বার্নার্ড শ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি : ‘আমি সবসময় মুহাম্মাদের ধর্মকে উচ্চমর্যাদা দিয়েছি এর আশ্চর্য জীবনীশক্তির জন্য। এটিই একমাত্র ধর্ম, যার পরিবর্তনশীল দুনিয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোর মতা আছে বলে আমার মনে হয়। আর এ ধর্ম সর্বযুগেই সমাদৃত হতে পারে। আমি এ বিস্ময়কর লোকটিকে বুঝতে চেষ্টা করেছি এবং আমার মতে, তিনি অ্যান্টি-ক্রাইস্ট তো ননই বরং তাঁকে মানবজাতির ত্রাণকর্তা বলা উচিত। আমার বিশ্বাস, তাঁর মতো একজন মানুষ যদি বর্তমান বিশ্বের একনায়ক হতেন তাহলে তিনি এ সমস্যাগুলোর এমন সমাধান দিতে সক্ষম হতেন, যা পৃথিবীতে শান্তি ও সুখ এনে দিত। মুহাম্মাদের ধর্মের ব্যাপারে আমি এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, এটি যেমন বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্য হতে শুরু করেছে তেমনি আগামী দিনের ইউরোপেও তা গ্রহণযোগ্য হবে’ (জর্জ বার্নার্ড শ, দ্য জেনুইন ইসলাম, সিঙ্গাপুর, ভলিউম ১, ১৯৩৬)।
এখন যখন মানবসম্প্রদায় নানা যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ছে এবং ‘শক্তিশালী’ ও ‘উগ্র’ এই দুই শক্তির দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন এবং নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠরা চরম ভয়ভীতি ও অস্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছে, তখন এমন লোকের আবির্ভাব, যিনি মানবজাতির ত্রাণকর্তার অনুসারী, সবার কাছেই একটি স্বাগত সংবাদ হবে। মানবজাতির অনুকরণীয় আদর্শ নবীজি হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর শুভ জন্মদিনে মহান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা হোক মানবজাতির পরিত্রাণ।
Saturday, December 2, 2017
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment