আফ্রিকা মহাদেশের প্রধান শিল্প প্রধান ও সম্পদশালী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার নাগরিক জীবিকা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সন্ধানে ছুটে যায় দেশটিতে। বাংলাদেশ থেকেও প্রায় দেড় লাখের মতো প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছে সেখানে। যাদের অধিকাংশই অবৈধভাবে দেশটিতে প্রবেশ করে ব্যবসা বাণিজ্য করছে দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির অর্থনৈতিক মন্দা আর মুদ্রামানের দরপতন থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুদিন হারিয়েছে ব্যবসায়ীরা। যার বড় ধরণেল প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের । অতিরিক্ত উপার্জন আর বেঁচাকেনা না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে বহু বাংলাদেশি ফিরে আসছে দেশে। স্বপ্ন আর বাস্তবতার এই বিস্তর ফাঁরাকে কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়ে আত্মহত্যার মত পথও বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
কিন্তু কি এমন কারণ যার জন্যে দ. আফ্রিকা থেকে ফিরতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের? ভুক্তভোগী এমনই একজন প্রবাসী ব্যাক্তির সন্ধান মিলল ঢাকার দোহারে। যার নাম মোযাফফর হোসেন। যিনি অনেক স্বপ্ন আর বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে চার মাস আগে দ.আফ্রিকায় গিয়েছিলেন। নিজের এক আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ. আফ্রিকায় কেপটাউন শহরে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের দোকান দেন। যেখানে তিনি পাঁচ লাখের মত বাংলাদেশি টাকা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সারাদিনে যে পরিমান বেঁচা-কেনা হয় তাতে তিনি দেখেন যে তার থাকা-খাওয়াটা কোনভাবে চলে যায়। দেশে টাকা পাঠানো আর হয়না। এমন পরিস্থিতি দেখে এক পযায়ে তিনি দোকান বিক্রি করে চলে আসেন দেশে। ঢাকার মোযাফফরের মতো মানিকগঞ্জের আমজাদ ও ফারুক হোসেনেরও অবস্থা একই। অতিরিক্ত মুনাফা আর ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে দ.আফ্রিকায় গিয়েছিলেন প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করে। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনা আর দেশটির সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক দুর্দশায় তাদেরকে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হতে হয়।
সম্প্রতি দেশটির অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে হাজার হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে। কারণ দ. আফ্রিকায় শতকরা ৮০ ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িত। যাদের কেউ দোকান মালিক আবার কেউ সেই দোকানের কর্মচারী। বাকী ২০ ভাগ বাংলাদেশি দেশটিতে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক দক্ষিণ আফ্রিকায় যায় তাদের শতকরা ৮০ ভাগ দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে দোকান ভাড়া নিয়ে বা ক্রয় করে ব্যবসা করে। আর যাদের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে তারা যৌথভাবে দেশটির শহরে ব্যবসা করছে। মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরা দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান, কেপটাউন, জোহানেসবার্গ কিংবা প্রিটোরিয়ার মত প্রশাসনিক রাজধানীতে ব্যবসা করে থাকে। এভাবে ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশিদের দেশে ফিরে আসার কারণ জানতে চাইলে প্রবাসী সাংবাদিক আলম আল-আমিন ভয়েস বাংলাকে জানান, দুটি কারণে মূলত প্রবাসী ব্যবসায়ীরা দেশে ফিরে যাচ্ছে, তার মধ্যে প্রথমটি হলো- সাম্প্রতিক সময়ে দ.আফ্রিকার অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রামানের নিম্নগতি এবং দ্বিতীয়টি হলো ডাকাতদের অত্যাচার ও লুটপাট।
এর বাইরে তিনি আরও জানান, প্রবাসী বাংলাদেশি হত্যা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হওয়ার পেছনে আর যে কারণটি গুরুতর, তা হলো নারী ঘটিত ব্যাপার । বেশিরভাগ প্রবাসী ব্যবসায়ী বিশেষ করে যারা শ্রমিক হিসেবে প্রবেশ করে দেশটিতে ব্যবসা করছে, তারা দেশটির মেয়েদের সাথে এক ধরণের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়ে নির্মম অত্যাচার কিংবা জীবন হারাতে হয়েছে।তবে ভিন্ন চিত্র রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেকেরই। যারা দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বানিজ্য করছেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে কেপটাউন শহরে ব্যবসা করছেন ঢাকার দোহারের সাইফুল ইসলাম। যিনি এখন পরিবার নিয়ে সেখানে ব্যবসা বানিজ্য করছেন। ভয়েস বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘সার্বিক দিক বিবেচনা করলে আসলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তবে অনেকেই আবার ভালো অবস্থানে রয়েছে। ৯৬ এর প্রথম দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিল তাদের অনেকেই খুব ভাল অবস্থান করে নিয়েছেন। সেখানে বাড়ি, গাড়ি, বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। আবার অনেকেই স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে আগে যে পরিমান ইনকাম ছিল এখন সে পরিমান নেই।
তার কারণ হিসেবে তিনি জানান, দেশটির মুদ্রামান, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রবাসী দেশটিতে প্রবেশ করা।তবে এখন যারা যাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে সে টাকা তুলতে না পারায় হতাশ হচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে দ.আফ্রিকায় বাংলাদেশ দূতাবাস চালু হলেও কূটনৈতিক তৎপরতা না থাকায় বৈধভাবে শ্রমিক প্রবেশের কোন অনুমতি আজও মেলেনি। যার কারণে লাখ লাখ টাকা খরচ করে এজেন্টদের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করছে বাংলাদেশি শ্রমিকরা। তারপর সেখানে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বছরের পর বছর ঝুঁকি নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে এসব প্রবাসীরা।
তবে সেখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির দাবি, যদি বাংলাদেশ সরকার এবং দূতাবাস তৎপর হয় তাহলে দেশটিতে অবস্থানরত দেড় লক্ষাধিক প্রবাসীর জীবনমানের একটা নিশ্চয়তা তৈরী হবে, তৈরী হতে পারে নতুন কোন শ্রমবাজার। এতে বৈধভাবে দেশে রেমিটান্স পাঠানো সম্ভব হবে, ফলে বেড়ে যাবে দেশের রেমিটেন্স প্রবাহ।