ইউরোপ মহাদেশের নরডিক অঞ্চলের একটি অন্যতম সুন্দর দেশ ফিনল্যান্ড। বিভন্ন কারণে এই দেশটি ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে বিখ্যাত। এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটি দেশটির জনসংখ্যা অনুযায়ী বেশ বড়। এদেশে অধিকাংশ বাংলাদেশিই এসেছে পড়াশুনা করতে। তারপর আস্তে আস্তে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন পেশায়। আর কেউ কেউ আস্তে আস্তে নিজের ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে তুলছে। শিক্ষাব্যবস্থা ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, অসংখ্য কলেজ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল রয়েছে। ইউরোপের যে দেশেগুলোতে টিউশন ফি ছাড়া উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যায় তাদের একটি ফিনল্যান্ড। এদেশে প্রতি বছর এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। তবে তাদের বেশিরভাগই স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। আর এদেশে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার বিশেষ সুযোগ রয়েছে।
ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ করে স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান আছে। যার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন ফলিত বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হয়। তাছাড়া সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান আছে যার মাধ্যমে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনটিতে ভর্তির জন্য আবেদন করা যায়। কিন্তু স্নাতকোত্তর বিষয়াবলীর জন্য এককভাবে সম্পৃক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য আবেদন করার সুযোগ আছে। ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রভাষা দুটো- ফিনিশ আর সুইডিশ। তবে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিনিশ ভাষায় পড়াশোনা করতে হয়। সে জন্য বিশেষ করে স্নাতক স্তরের পড়াশুনার জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের ফিনিশ বা সুইডিশ ভাষার ওপর ভালো দক্ষতা থাকতে হবে। তবে একজন বিদেশিকে অবশ্যই প্রাথমিক ভাষা দক্ষতা হিসেবে ইংরেজি জানতে হবে, তা না হলে সমস্যায় পড়তে হবে।
উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও স্তর বিন্যাস উচ্চশিক্ষার জন্য ফিনল্যান্ডে ২৭ টি ফলিত বিজ্ঞানের এবং ১৬টি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ফলিত বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত পলিটেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। এদেশে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে বড়। ফিনল্যান্ডের উচ্চশিক্ষার কাঠামো দু’ভাগে বিভক্ত। স্নাতক স্তর (Undergraduate Level) ও স্নাতকোত্তর স্তর (Postgraduate Level। স্নাতকোত্তর আবার দু’স্তরে বিন্যাস্ত- মাস্টার্স ও ডক্টোরাল। উচ্চশিক্ষার এ দু’স্তরে যেসব ডিগ্রি অর্জন করা যেতে পারে, সেগুলো হলো- ক) ব্যাচেলর ডিগ্রি, খ) মাস্টার্স ডিগ্রি ও গ) ডক্টরেট বা পিএইচডি ডিগ্রি। মাস্টার্স করতে দেড় থেকে দুই বছর লাগে আর ১২০ ক্রেডিট সম্পপন্ন করা লাগে। কিন্তু যে কেউ চাইলে বেশি সময়ও নিতে পারে। তবে চার বছরের মধ্যেই মাস্টার্স কোর্স শেষ করতে হবে। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুই বছরের মধ্যে মাস্টার্স কোর্স শেষ করার জন্য উৎসাহ দিয়ে থাকে। আর ডক্টরাল কোর্সের ক্ষেত্রে সাধারণ সময় লাগে তিন থেকে ছয় বছর।
ফিনল্যান্ডে ডক্টরেট করতে হলেও ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা অবশ্যই থাকতে হবে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই ডক্টরাল কোর্সে ভর্তি হতে হলে অবশ্যই আইইএলটিএস (IELTS) স্কোর অথবা আর সমমানের ইংরেজী ভাষা কোর্সের সার্টিফিকেট থাকতে হবে। স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তির জন্য সাধারণ সর্বনিম্ন আইইএলটিএস স্কোর ৬.৫ দরকার। এদেশে ডক্টরাল কোর্সে ভর্তির জন্য সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে পছন্দের বিষয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। তারাও ভর্তি সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন। এদেশেও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতোই দুই সেমিস্টারে পড়াশুনা পরিচালিত হয়। প্রথম সেমিস্টার হলো শরৎকালীন (Autum) সেমিস্টার- আগস্ট থেকে ডিসেম্বর। আর দ্বিতীয় সেমিস্টার হলো বসন্তকালীন (Spring) সেমিস্টার- জানুয়ারি থেকে জুলাই।
স্নাতক ডিগ্রির ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডে যে বিষয়ে পড়তে পারবে তা হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্লাস্টিক প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি, পরিবেশ প্রকৌশল, নার্সিং, সামাজিক সেবা, ভ্রমণ ও আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য তথ্য প্রযুক্তি এবং ইলেকট্রোনিক্স। এছাড়া স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তির জন্য সাধারণত কোন ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না। অনলাইনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নির্ধারিত ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে হবে। এরপর ভর্তির জন্য বিবেচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় চিঠি কিংবা মেইল দিয়ে জানাবে। এমনকি অফার লেটার পেলে প্রয়োজনে ১ বছরের জন্য ভর্তি ডেফার/পোস্টপন্ড করা যায়।
স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর জন্য যে বিষয়ে পড়া যাবে সেগুলো হলো শিল্পকলার ইতিহাস, সৃজনশীল লেখা, সামাজিক গবেষণা পদ্ধতি, বয়স্ক শিক্ষা ও জীবনব্যাপী শেখা, অর্থনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজ, গণতন্ত্র ও বৈশ্বিক পরিবর্তন, উন্নয়ন অধ্যয়ন, গণমাধ্যম ও বিশ্ব যোগাযোগ,সংবাদ মাধ্যম অধ্যয়ন, উত্তর আমেরিকা অধ্যয়ন, ইউরোপ অধ্যয়ন, ধর্ম, দ্বন্দ্ব ও সংলাপ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক আইন, আন্তর্জাতিক গণ আইন, মেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড ইত্যাদি। আবেদনের প্রক্রিয়া ফিনল্যান্ডের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হওয়ার জন্য সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে আবেদনপত্র ডাউনলোড করতে হবে। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি অনলাইনে আবেদন করতে হয়। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ যথাসময়ে আবেদন করার পর অপেক্ষায় থাকতে হবে অফার লেটারের জন্য। তবে আবেদন করার পর থেকে ভিসা পাওয়া পর্যন্ত প্রায় বছর খানেক সময় লেগে যেতে পারে। আবেদন করার আগে ভালভাবে দেখে বুঝে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করতে হবে। কারণ কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার জন্য ফি পরিশোধ করতে হয়।
কোর্স বিশেষে টিউশন ফি ৮,০০০ থেকে ১০,০০০ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত মাস্টার্স কোর্সে পড়াশুনার জন্য বৃত্তি পাওয়া যায় না। সরাসরি ডক্টরাল কোর্সে পড়াশুনা করার জন্যও বৃত্তি পাওয়া বেশ কঠিন এবং তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। কিন্তু এইখানে মাস্টার্স করার পর ডক্টরাল কোর্সের জন্য আবেদন করলে বৃত্তি পাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়। অন্যান্য খরচ বৃত্তি না পাওয়া গেলে শুধু থাকা খাওয়ার খরচ নিজে ব্যবস্থা করতে পারলেই পড়াশুনা চালিয়ে নেয়া সম্ভব এখানে। প্রতি মাসে থাকা খাওয়ার জন্য গড়ে ৩৫০-৩৭০ ইউরো খরচ পড়ে। সেক্ষেত্রে আবাসিক ভাড়া: ২২০-২৪০ ইউরো, খাওয়া খরচ: ৮০-৯০ ইউরো এবং আনুসঙ্গিক খরচ: ২০-৪০ ইউরোর মধ্যে রাখা যাবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য বাৎসরিক ২৫ থেকে ৭৫ ইউরো ব্যয় হতে পারে।
কমপিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তির শিক্ষার্থীদের জন্য ফিনল্যান্ডে চাকরির বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল। প্রথম বছর হয়তো একটু কষ্ট হয়। কিন্তু কোর্সের নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্রেডিট সম্পন্ন করার পর কাজ পেলে কিংবা বৃত্তি পাওয়া গেলে তখন কোন চিন্তা থাকে না। আবার ৫০ থেকে ৬০ ক্রেডিট সম্পন্ন করার পর শিক্ষা সহযোগীর (Teaching Assistantship- TA) পদে খণ্ডকালীন কাজ করার জন্য আবেদন করা যায়। আর শিক্ষা সহযোগী হতে পারলে মাস্টার্স থিসিস লেখার ও পরে ডক্টরেট করা জন্য বৃত্তির পথ অনেকটাই সুগম হয়ে যায়। ভিসা ব্যাংক ব্যালেন্স বাংলাদেশে ফিনল্যান্ডের কোন দূতাবাস না থাকায় স্নাতক স্তরে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিংবা স্নাতকোত্তর স্তরে অফার লেটার পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিস্থ ফিনিস দূতাবাসে ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে হয়। স্টুডেন্ট ভিসার জন্য নির্ধারিত ফর্ম ডাউনলোড করে স্পস্ট অক্ষরে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী পূরণ করে জমাদানের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট ও মার্কশিটগুলোর আসল কপি, বীমাপত্রের আসল কপি, জন্মনিবন্ধন সনদপত্র, ইংরেজী ভাষা দক্ষতার সনদপত্র (টোফেল অথবা আইইএলটিএস-এর স্কোর), ব্যাংক সার্টিফিকেট ও তিন মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্টের মূলকপি দেখাতে হবে। আবেদনপত্র এবং অন্যান্য কাগজপত্রের ২ সেট ফটোকপি ভিসার জন্য নির্ধারিত সাইজের ৪ কপি ছবিসহ জমা দিতে হবে।
ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের নিজ নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬,০০০ (ছয় হাজার) ইউরো সমমান টাকা এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত জমা রাখার প্রয়োজন হতে পারে। সব রকমের শিক্ষার্থীর জন্য ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া একই ধরনের। পড়াশুনার জন্য ফিনল্যান্ড ক্রমেই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষনীয় গন্তব্য হয়ে উঠছে। শিক্ষার মান ও বিদেশী শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধার বিচারে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফিনল্যান্ডে রয়েছে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ।
No comments:
Post a Comment