আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। গতকাল শুক্রবার মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে ৮৯ জন নিহত হয়েছেন। দ্য আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এই হামলার দায় স্বীকার করে আরো হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন মিয়ানমারের নেত্রী ও দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি।
রাখাইনে হামলার মাত্র একদিন আগেই সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান-সহ মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহবান জানায় রাখাইন রাজ্যের জন্য বিশেষভাবে গঠিত ‘অ্যাডভাইজরি কমিশন’। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে কমিশন প্রতিবেদনে আরো জানায়, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান না দেখালে রোহিঙ্গা এবং সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী কট্টরপন্থার দিকে ধাবিত হতে পারে। এদিকে গতকাল সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে ১৪৬ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। টেকনাফ সীমান্তে বিজিবি’র পক্ষ থেকে সতর্ক অবস্থা জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার বিজিবি সদর দপ্তরে এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। খবর:রয়টার্স, এএফপি ও আল জাজিরা’র।
৩০ পুলিশ চেকপোস্ট ও এক
সেনাঘাঁটিতে সমন্বিত হামলা
শুক্রবার ভোরের আগে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা রাখাইন রাজ্যের ৩০টি পুলিশ চেকপোস্ট ও একটি সেনাঘাঁটিতে সমন্বিতভাবে হামলা চালায়। মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীর বরাত দিয়ে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, গতকাল সন্ধ্যায়ও রাখাইনের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। অং সান সুচি’র কার্যালয় জানিয়েছে, সংঘর্ষের ঘটনায় এক সেনা, এক অভিবাসন কর্মকর্তা ও ১০ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে। তাদের সঙ্গে লড়াইকালে ৭৭ রোহিঙ্গা বিদ্রোহী মারা গেছে বলে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাত একটার দিকে ‘বাঙালি’ উগ্রপন্থীরা হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা মংডুর বেশ কয়েকটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালিয়েছে। বিদ্রোহীরা হামলায় লাঠি এবং তলোয়ার ব্যবহার করেছে এবং বিস্ফোরক দিয়ে একটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। সামরিক সূত্র রয়াটর্সকে বলেছে, এক হাজারের বেশি বিদ্রোহী মংডু ও বুথিডং জেলার বিভিন্ন এলাকায় হামলায় অংশ নিয়েছে। বিদ্রোহীরা চেকপোস্টগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুলিশ সদস্যদের প্রধান স্টেশনে জড়ো হতে বলা হয়েছে। সেনাবাহিনী বলেছে, প্রায় ১৫০ রোহিঙ্গা বুথিডং জেলার তং বাজার গ্রামের সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালায়।
দ্য আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’র দায় স্বীকার
রাখাইনে হামলার দায় স্বীকার করে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (এআরএসএ) বলেছে এ ধরনের আরো হামলা চালানো হবে। আগে এই সংগঠনটি হারাকাহ আল-ইয়াকিন নামে পরিচিত ছিল। গত বছরের অক্টোবরের পর রাখাইনে এটি সবচেয়ে বড় হামলা। সে সময় পুলিশ চেকপোস্টে এ ধরনের হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হয়। দায় স্বীকার করা এআরএসএ’র নেতা আতা উল্লাহ জানিয়েছেন, তাদের সংগঠনে শত শত তরুণ রোহিঙ্গা যুবক যোগ দিয়েছে। তারা মানবাধিকারের জন্য সেনাবাহিনীকে ন্যায়সঙ্গতভাবে মোকাবেলা করবে। টুইটারে সংগঠনটি বলেছে, বার্মিজ লুণ্ঠনবাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫টির বেশি জায়গায় আমরা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এ ধরনের আরো ঘটনা ঘটবে।
নেত্রী অং সান সুচির নিন্দা
পুলিশ চেকপোস্ট ও সেনাঘাঁটিতে হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন মিয়ানমারের কার্যত সরকার প্রধান অং সান সুচি। স্টেট কাউন্সেলর পদে থাকা সুচি এক বিবৃতিতে বলেছেন, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের এই হামলা সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হুমকি তৈরি করবে। বিদ্রোহীদের এ ধরনের সহিংস কার্যকলাপে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে না।
রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক
হামলার ঘটনায় স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গতকালের হামলা অনেক বেশি সংগঠিত। এর ফলে নতুন করে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
১৪৬ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি
ইত্তেফাকের টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, গতকাল শুক্রবার উপজেলার হোয়াইক্যং উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্ঠাকালে ১৪৬ জন রোহিঙ্গাকে বিজিবি সদস্যরা আটক করেন। আটককৃতদের মধ্যে নারী শিশু পুরুষ ও বৃদ্ধরা ছিলেন। পরে বেলা ১১টার দিকে নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল এস.এম. আরিফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এ ধরণের সহিংসতায় বিজিবি’র পক্ষ থেকে সতর্ক অবস্থা জারি করা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় বিজিবি সদর দফতরে বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন রিজিয়ন কমান্ডার ও সেক্টর প্রধানদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের অক্টোবরে একই ধরনের হামলায় ৯ পুলিশ নিহত হওয়ার পর রাখাইন রাজ্যে বড় আকারের সামরিক অভিযান চালানো হয়। তখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ ওঠে। সেই সময় থেকে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা একে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
No comments:
Post a Comment