অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জেগে থাকা অপূর্ব দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড। এ দেশটিতে প্রায় চার হাজার বাংলাদেশি বসবাস করে, যাদের মধ্যে এক অকল্যান্ডেই থাকে সাড়ে ৩ হাজার। রাজধানী ওয়েলিংটন ও ক্রাইস্টচার্চ প্রতিটি শহরেই মাত্র ৭০ থেকে ৭৫ জন করে, ডুনেডিনে হাতে গোনা দশ-বারো জন আর বাকি কয়েকশ’ বাংলাদেশি আছেন তাউরাঙ্গা সিটিতে। গত প্রায় বিশ বছর ধরে মূলতঃ অকল্যান্ডকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি কমিউনিটি।
ইউরোপের বহু দেশের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ দেশ নিউজিল্যান্ড। বাংলাদেশিরা অনেকটা ঢালাওভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এদেশে। প্রায় সবাই বসবাস করছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। নিউজিল্যান্ড প্রবাসী মীর সাজ্জাদ হোসেন। তিনি নিউজিল্যান্ডে একজন চিকিৎসক। সাজ্জাদ হোসেন বলেন, নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশিদের প্রায় ১৫% ডাক্তার, ১০% ইঞ্জিনিয়ার এবং ৫% বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে করছেন। আর বাকিদের বড় একটা অংশ ট্যাক্সি চালিয়ে আয় করছেন। তিনি বলেন, ট্যাক্সি চালিয়ে মাসে গড়পড়তায় ৬ হাজার ডলার আয় করেন এখানকার প্রায় ৩০% বাংলাদেশি, যারা বিভিন্ন ট্যাক্সি কোম্পানির শেয়ার কিনেও অর্থনৈতিকভাবে বাড়তি লাভবান হচ্ছেন।
মীর সাজ্জাদ হোসেন বলেন, নিউজিল্যান্ডে রিয়েলএস্টেট ব্যবসার সাথেও সম্পৃক্ত রয়েছে বাংলাদেশিরা। যারা একসময় ট্যাক্সিক্যাব থেকে পুঁজি তৈরী করেছেন তারাই মূলত রিয়েলএস্টেট ব্যবসায় ভালো কাজ করছেন। তিনি বলেন, এই ধরনের ব্যবসায়ীরা জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে বিক্রি করে ভালো আয় করছেন। সাজ্জাদ বলেন, শিল্পকারখানায়ও কাজ করছেন অনেক বাংলাদেশিরা। তিনি জানান, বাংলাদেশিদের নতুন প্রজন্ম অনেক ভালো করছে নিউজিল্যান্ডে। অনেক ছেলেমেয়েরা যাদের জন্ম সে দেশে, তারা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরী করছেন। বেশ কয়েকজন ল-ইয়ারও হয়েছেন এরই মধ্যে। উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশে থেকে গিয়েছেন এমন প্রায় ৫শ’ ছাত্র-ছাত্রী শোভা বর্ধন করেছে এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির।
বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহর-নগরের তালিকায় নিউজিল্যান্ডের শহরগুলো অন্যতম। সাজ্জাদ হোসেন বলেন, মাত্র ৪ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশেটিতে অপরাধ প্রায় হয় না বললেই চলে। সাগর পথে নেই অবৈধ অভিবাসীদের আগমন। আগে বিভিন্নভাবে যারা গিয়েছেন সেখানে, তাদের অনেকেই বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বৈধতা পেয়েছিলেন। কিন্তু নতুন অভিবাসীদের বৈধতা দিচ্ছে না নিউজিল্যান্ড সরকার। তাই নতুনদের নিউজিল্যান্ডে যাওয়াটা বর্তমানে অনেক জটিল বলে প্রবাসী এই ডাক্তার। তিনি জানান, বর্তমানে অবৈধভাবে কোনো বাংলাদেশি নেই, যারা ছিলো তারা সবাই স্থায়ী বসবাসের অনুমতি বা নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে। ধর্মীয় স্বাধীনতার দেশ নিউজল্যান্ড।
শুধু বাংলাদেশিদেরই প্রতিষ্ঠিত ৮টি মসজিদ আছে অকল্যান্ডে। ইউরোপের মতো ‘ইসলামিক কালচারাল সেন্টার’ হিসেবে নয়, বরং সরাসরি মসজিদ হিসেবে সরকারী অনুমতি নিয়ে চলে এগুলো। সাজ্জাদ বলেন, ছুটির দিন রোববারে পরিচালিত হয় একটি বাংলা স্কুল, যার লক্ষ্য নতুন প্রজন্মকে বাংলার বন্ধনে বেঁধে রাখা। অরাজনৈতিক দু’টি বাংলাদেশ এসোসিয়েশন আছে অকল্যান্ডে। এখানকার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ভাগ বাংলাদেশি নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার সাথে কাজ করছেন বলে জানান সাজ্জাদ হোসেন।
বিভিন্ন ডে-কেয়ার সেন্টার, ওল্ড-হোম এবং শপিং সেন্টারগুলোতে বাংলাদেশি মেয়েদের অনেক সুনাম রয়েছে। বিভিন্ন দেশের মায়েদের থেকে বাংলাদেশি মায়েরা বেশি বিশ্বস্ত নিউজিল্যান্ডের নাগরিকের কাছে বলেও জানান সাজ্জাদ। শুধু অকল্যান্ড নয়, ২শ’ কিলোমিটার দূরের বন্দরনগরী তাউরাঙ্গা, যেখানে কয়েকশ’ বাংলাদেশি খুব সুনামের সাথে কাজ করছেন কিউই খামারে। অত্যন্ত সুস্বাদু এই ফলের বিশাল অবদান কৃষিপ্রধান দেশ নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতিতে। যার বিরাট একটা অংশ রয়েছে বাংলাদেশিদের দখলে।
সাজ্জাদ বলেন,’ এখন বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের বিকল্প নেই নিউজিল্যান্ডে। কারণ দূতাবাস না হলে আমাদের এ দেশে প্রবেশের সহজ কোনো প্রক্রিয়া থাকবে না’। তাই দ্রুত দূতাবাস স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে নিউজিল্যান্ডের সর্ম্পক আরও উন্নত করার দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করন মীর সাজ্জাদ হোসেন।
No comments:
Post a Comment