চাঞ্চল্যকর এটিএম বুথ জালিয়াতির খলনায়ক থমাস পিটার অবশেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার তিনি মহানগর হাকিম আতিকুর রহমানের খাস কামরায় জবানবন্দি দেন। এতে পিটার এটিএম কার্ড জালিয়াতির পুরো বিষয়
খোলাসা করেন। পিটারের স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তার এ দেশীয় সহযোগীদের নামও। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পিটারের এ ভয়াবহ জালিয়াতির অন্যতম আশ্রয়দাতা ছিলেন খোদ গুলশান থানার ওসি (তদন্ত) ফিরোজ কবির।আছেন আরও অনেক প্রভাবশালী। এমনকি এটিএম কার্ড জালিয়াতিতে সহায়তা করে নামকরা জুয়েলার্স ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এদিকে পিটারকে বৃহস্পতিবার গুলশান থানার একটি জালিয়াতি মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে আনা হয়। আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়ার বিষয়ে সূত্র জানায়, জবানবন্দি দেয়ার আগে পিটার দিনভর নানা নাটক করেন। তিনি জার্মানিতে ফিরতে চান না- এমন আবদারও করেন গোয়েন্দাদের কাছে। তার দাবি, এ মামলায় তার সাজা হবে না। একই সঙ্গে ধূর্ত পিটার দাবি করেন, তার বাংলাদেশী সহযোগীদের গ্রেফতার করা হোক। গোয়েন্দাদের কৌশলী জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পিটার জবানবন্দি দিতে রাজি হন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গুলশান থানার ওসি (তদন্ত) ফিরোজ কবির এটিএম কার্ড জালিয়াতির অন্যতম হোতা। পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও তিনি ব্ল্যাকমেইল করে পিটারের কাছে ঘুষ আদায় করতেন। কারণ ওসি ফিরোজ জানতেন পিটার অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সময়ে ভয় দেখিয়ে ওসি ফিরোজ কবির পিটারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকাও আদায় করতেন। ফিরোজ এ টাকা দিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করেন। গুলশানের অভিজাত এলাকায় তিনি কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল গাড়িও কিনেছেন। এছাড়া নামকরা একটি জুয়েলার্স, ফাহিম মিউজিক, আরিয়ান ট্রাভেলসের মতো প্রতিষ্ঠান এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। আরও জড়িত ছিলেন খান এয়ার ট্রাভেলসের মালিক তৌহিদ খান ও তার কর্মকর্তা আবু জাফর। এছাড়া আরও ১০-১২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাকে এ ঘৃণ্য কাজে সহায়তা করতেন। গোয়েন্দারা জানান, আবু জাফর ১০-১২টি পস (পয়েন্ট অব সেলস) মেশিন এনে দিতেন। এসব মেশিন তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করতেন, তা পিটার জানতেন না। জবানবন্দি : আদালতে দেয়া জবানবন্দির অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হল- তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি টমাস পিটার উইচ। আমার জর্মান ও পোল্যান্ডের নাগরিকত্ব রয়েছে। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর মি. ফরিদ স্পেন থেকে আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। ফরিদের সঙ্গে তার বার্সেলোনার একটি রেস্টুরেন্টে পরিচয় হয়। ফরিদ লন্ডন বিএনপির নেতা। বাংলাদেশে ফরিদের জনশক্তি রফতানির ব্যবসা রয়েছে। এখানে আসার কিছুদিন পর অনেক বিদেশী নাগরিকের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে তিনি দেখতে পান জনশক্তি রফতানি ও এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে এসব নাগরিকের অনেকেই জড়িত। বিভিন্ন বৈঠকে এসব জালিয়াতি সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হতো। একপর্যায়ে সম্ভবত ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ফরিদ তার রোমানিয়ার এক মেয়েবন্ধুসহ লন্ডনে চলে যান। এ বিষয়টি পরে হোটেল থেকে জানতে পারেন পিটার। এছাড়া ফরিদের সাঙ্গপাঙ্গরা তাকে একা ফেলে ঢাকা থেকে সিলেটে চলে যান। এক পর্যায়ে পিটার ইমিগ্রেশন ও ভিসা পরামর্শ ব্যবসা শুরু করেন। গ্রাহকরা তার সঙ্গে হোটেল হলিডে প্লানেটে যোগাযোগ করতেন। এই হোটেলে পিটার ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত অবস্থান করেন। গত বছর জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির দিকে তিনি গুলশানের খান ট্রাভেলস এজেন্সির সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করেন। খান ট্রাভেলসের মালিক তাওহিদ খানের সঙ্গে তিনি অফিস করতেন। তারা মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রসেস করতেন। এক সময় তাওহিদ খান জানতে পারেন পিটারের বিজনেস ভিসা অবৈধ। আমি তাকে এ বিষয়ে নিশ্চিতও করি। আমরা একসঙ্গে অনেকদিন রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করি। সে খুবই দেশপ্রেমিক এবং সরকারের গুণগ্রাহী। এ কারণে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে কোনো প্রতারণা করব না। একদিন আমার মাথায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার চিন্তা এলো। যেহেতু আমার এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে সে কারণে আমি জানি, লন্ডনের লোকেরা কিভাবে বাংলাদেশে প্রাইভেট ব্যাংকের টাকা লেনদেন করে। বাংলাদেশে আসার পর এ বিষয়ে আরও জানতে পারি। আমি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু কোনো প্রাইভেট ব্যাংকের সঙ্গে নয়। কারণ প্রাইভেট ব্যাংকের অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। আমি আশা করি, এসব প্রাইভেট ব্যাংকের দুর্নীতি থামানো উচিত। গত বছর জানুয়ারিতে ফরিদ ব্যবসার জন্য পুনরায় ঢাকায় আসেন। তিনি বাংলাদেশে এটিএম মেশিন সরবরাহ করতে চান। যেসব মেশিনে গোপন স্কিমিং ডিভাইস লাগানো আছে। এ সময়ে আমি তার সঙ্গে দু-তিনবার দেখা করি। একদিন সন্ধ্যায় লন্ডনের অনেকে রাজধানীর গুলশান-২ এ অবস্থিত একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ১০-১৫ মিনিট মাতাল অবস্থায় কথা বলি। তারা আমার সাহায্য চান। পরদিন হলিডে প্লানেট হোটেলে দেখা হলে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চায়। যে পদ্ধতিটি আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম সেই পদ্ধতিটি নিয়ে তারা আমার সঙ্গে কথা বলেন। কিছুদিন পর আমি রোমিওকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসি। তার সঙ্গে এটিএম মেশিনের যন্ত্রপাতি ছিল। আমি তাকে হলিডে প্লানেট হোটেলে রাখি। এ হোটেলে আমার ইউক্রেনের বন্ধু আন্দেও আগে থেকেই অবস্থান করছিল। সূর্যমুখী তেল ও ইউরিয়া সার ব্যবসার জন্য সে বাংলাদেশে অনেকবার এসেছে। আমি দেখি যে, রোমিও যে দুটি মেশিন নিয়ে এসেছেন তা দিয়ে সে এটিএম মেশিনের তথ্য সংগ্রহ করতে চায়। আমি জানতাম, এই সবুজ রংয়ের মেশিন ইউরোপে খুবই জনপ্রিয়। এ সময় আমি আমার স্ত্রীর বাচ্চা জন্মের অপেক্ষায় ছিলাম। এটা আমার প্রথম সন্তান। আমার স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। একদিন আমি বনানীতে বাচ্চাদের কাপড়ের দোকানে কাপড় কিনতে যাই। এ সময় রোমিও স্কিমিংয়ের জন্য উপযুক্ত এটিএম বুথ খুঁজতে থাকে। পরদিন সকালে সে একটি ইলেক্ট্রিক দোকানে গিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে নেয়। পরদিন বনানীর একটি এটিএম বুথের তথ্য সংগ্রহের জন্য স্কিমিং ডিভাইস বসায় এবং সন্ধ্যায় খুলে নিয়ে আসে। পরে রোমিও বলে এই স্কিমিং ডিভাইস ভালো নয়। পরদিন সম্ভবত একই এটিএম বুথে স্কিমিং ডিভাইস স্থাপন করে। আমি সে সময় এটিএম বুথের কাছে ছিলাম না, কারণ ওই রাস্তায় অনেক এটিএম বুথ ছিল। পরদিন গুলশানের পিং সিটি মার্কেটের বিপরীত পাশ থেকে পিঠা কিনে খায়। সেখানে একটি বুথে স্কিমিং ডিভাইস ব্যবহার করে রোমিও। পরদিন গুলশান-১ ও ২ নম্বরে সার্কেলের আশপাশেও বিভিন্ন এটিএম বুথে এভাবে কাজ করেন তারা। এক্ষেত্রে তাদের গাড়িচালকরাও সঙ্গে থাকতেন। তাদের সঙ্গে স্কিমিং অ্যাপারেটার্সও থাকত। যখন তার কাজ শেষ হয় সে বলে, তারা এসব মেশিন ব্যবহার করে ইউরোপ থেকেও টাকা চুরি করতে পারবে। গুলশান-১ ও ২ নম্বর থেকে একাধিক এটিএম বুথের টাকা চুরি করা হয়। ১৫ লাখ টাকা চুরি করে পিটার বাসায় চলে যান। পরদিন সকালে রোমিও এবং পিটার একসঙ্গে গাড়িতে বের হন। কিন্তু পিটার জানতেন না কতটি কার্ডে ক্যাশ আউট হয়েছে। তার ধারণা এ সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০টির বেশি হবে না। তার বাসায় যাওয়া প্রয়োজন ছিল। কারণ তার স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন। যখন বাসায় পৌঁছায় তখন তার স্ত্রী হাসপাতালে যেতে বলে। এ সময় শাহাবুদ্দিন মেডিকেলে ফোন করে চলে যান। ডাক্তারের পরামর্শে পরে ইউনাইটেড হাসপাতালে তারা চলে যান। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লোকজনের সঙ্গে কথা বলি। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে তথ্য শেয়ারও করি। পাঁচ দিনের রিমান্ডে পিটার : স্বীকারোক্তি শেষে গুলশান থানার জালিয়াতির মামলায় মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমান পিটারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে বনানী থানায় দায়ের হওয়া তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় ৬ মার্চ তৃতীয় দফায় চার দিন রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। ওই রিমান্ডে থাকাকালে পিটার স্বীকারোক্তি দিতে চাইলে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। প্রসঙ্গত, ২২ ফেব্রুয়ারি পিটারসহ চারজনকে ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এ মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মোকসেদ আল মাকসুদ, রেজাউল করিম ও রেফাত আহমেদ ওরফে রনি এবং মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা হুমায়ন কবির ও আইটি সলিউশনের কর্মকর্তা সাইফুজ্জামান বর্তমানে কারাগারে আছেন। গত ৬ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাজধানীর ইস্টার্ন, সিটি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চার বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে কার্ডের তথ্য চুরি ও পরবর্তী সময়ে কার্ড ক্লোন করে গ্রাহকদের অজান্তে টাকা তুলে নেয়া হয়। এ ঘটনায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) কর্তৃপক্ষ জালিয়াতির অভিযোগে রাজধানীর গুলশান থানায় এ মামলা করে। একইদিন সিটি ব্যাংকের দায়ের করা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় বলা হয়, বনানীতে (ইউসিবি) একটি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসানোর সময় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় এক বিদেশীর ছবি পাওয়া গেছে


No comments:
Post a Comment