প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছি। স্বাধীনভাবে চলতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিয়েছি। স্বাধীনতা ভালো তবে তা বালকের জন্য নয় বলে একটা কথা আছে। কাজেই ওই বালকসুলভ আচরণ আমরা আশা করি না। ’ তিনি আরো বলেন, ‘সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে এটা আমরা কিছুতেই সহ্য করব না। আর পাকিস্তান রায় দিল দেখে কেউ ধমক দেবে—আমি জনগণের কাছে এর বিচার চাই। আমি জনগণের কাছে বিচার চাই যে পাকিস্তানের সঙ্গে কেন তুলনা করবে? আর এসব হুমকি আমাকে দিয়ে লাভ নাই। ’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা স্মরণে গতকাল সোমবার বিকেলে এক আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ ওই আলোচনাসভার আয়োজন করে।
আলোচনায় ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ এবং সম্প্রতি উচ্চ আদালতে নানা মন্তব্যের সমালোচনা করেন বক্তারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায় ৫০ মিনিটের বক্তব্যের বেশির ভাগ জুড়েই ছিল প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের শরিক অন্য নেতারাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই—এ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা থাকুক। আর সে ধারাবাহিকতা থাকবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলে। আর রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির মেম্বার এরা ক্ষমতায় আসলে এ দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকবে না। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির যে ষড়যন্ত্র, এই ষড়যন্ত্র বারবার এ দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে ব্যাহত করেছে। আবার এখন এসেছে উচ্চ আদালতের ভূমিকা এবং সেখানে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। আর সব থেকে যেটা অপমানজনক যে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা; যে পাকিস্তানকে আমরা যুদ্ধে হারিয়েছি, যুদ্ধে হারিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। অনেকেই পাকিস্তানের দালালি করেছে। হ্যাঁ, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে সেই দালালগোষ্ঠী ক্ষমতায় এসেছিল। এটা হলো বাস্তবতা। ’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমি ও আমার ছোট বোন বাবা-মা হারিয়েছি, আত্মীয়স্বজন হারিয়েছি। আমাদের তো বিচার চাওয়ারই সুযোগ ছিল না। ইনডেমনিটি করে বিচার চাওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা বিচার চাইব, আমরা এ দেশের নাগরিক, আমাদের সেই অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, হঠাৎ করে উচ্চ আদালত থেকে নানা ধরনের বক্তব্য, রাজনৈতিক কথাবার্তা এবং হুমকি-ধমকি। আমরা মাঝে মাঝে অবাক হই, যাদের আমরাই নিয়োগ দিয়েছি, মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগ পাওয়ার পরে হঠাৎ তাদের বক্তব্য শুনে... এবং পার্লামেন্ট সম্পর্কে যেসব কথা বলা হচ্ছে, পার্লামেন্ট সদস্য যারা, তাদের ক্রিমিনাল বলা হচ্ছে। সেখানে ব্যবসায়ী আছে, সেটাও বলা হচ্ছে। ব্যবসা করাটা কি অপরাধ? কোনো ব্যবসায়ী মামলা করলে উচ্চ আদালত কি তাদের পক্ষে রায় দেয় না? রায় তো দেয়। কারণ বিচার তো তারাও পায়। তারা যদি সংসদ সদস্য হয় তবে অপরাধটা কোথায়?’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই ধরনের পার্লামেন্টকে হেয় করা, পার্লামেন্টকে নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য দেওয়া—এটার অর্থটা কী?’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের প্রধান বিচারপতির রায়ে পার্লামেন্ট সম্পর্কে বক্তব্য, সংসদ সদস্য সম্পর্কে বক্তব্য, এমনকি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাও নিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা; এটা কোন ধরনের কথা? আমাদের সংবিধান আছে, যে সংবিধান আমরা ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি। সেই সংবিধানে কোন কোন অনুচ্ছেদ যেটা মূল সংবিধানে ছিল, সেটা ওনার পছন্দ না। পছন্দ কোনটা? ওই জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, এটা হাইকোর্টেরই রায় যে জিয়ার ক্ষমতা অবৈধ, সেই ক্ষমতা অবৈধভাবে দখল করে মার্শাল ল অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করে দিয়ে গেছে সেটা ওনার পছন্দ। কিন্তু আমাদের গণপরিষদ যে সংবিধান প্রণয়ন করে গেছেন সেটা ওনার পছন্দ না। সেখানে উনি চাচ্ছেন মার্শাল ল যেটা করে গেছেন সেটা। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার এখানে একটা প্রশ্ন, পুরো আদালতের দায়িত্ব সব ওনার হাতে দিতে হবে। তিনি কী করবেন? জয়নাল আবেদীন, তিনি জজ ছিলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার যে তদন্ত প্রতিবেদন তিনি দিয়ে গেছেন, সেটা সম্পূর্ণ ভুয়া, মিথ্যা তথ্য দিয়ে, মনগড়া তথ্য দিয়ে বলতে গেলে বিএনপি সরকারের ফরমায়েশি তদন্ত প্রতিবেদন তিনি দিয়ে গেছেন। তিনি যে দুর্নীতি করেছেন, সেই দুর্নীতির তদন্ত দুদক যখন করতে গেছে, দুদকের পক্ষ থেকে কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছিল, সেখানে প্রধান বিচারপতি চিঠি দিয়ে দিলেন যে এই জয়নাল আবেদীনের দুর্নীতির তদন্তও করা যাবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করবে। তদন্তে যদি দোষী প্রমাণিত হতেন তবে আদালতেই বিচার চাইতে যেতে হতো। তো আদালতে বিচার চাইলে না হয় তিনি কিছু বলতে পারতেন, কিন্তু তদন্তই করা যাবে না, এটা প্রধান বিচারপতি হয়ে তিনি কিভাবে বলেন? তার মানে একজন দুর্নীতিবাজকে প্রশ্রয় দেওয়া। দুর্নীতিবাজকে রক্ষা করা প্রধান বিচারপতির কাজ নয়। এটা তো সম্পূর্ণ সংবিধানকে অবহেলা করা, সংবিধানকে লঙ্ঘন করা। তাঁর (জয়নাল) বিচার করা যাবে না কেন?’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘বিএনপির আমলে এমন এমন জজ নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল যে দেখা গেল কারো আবার সার্টিফিকেট জাল। জাল সার্টিফিকেট দিয়ে বিচারক হয়ে গেছেন। কেউ বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বাথরুমের কাজ সারছিলেন। পুলিশ যখন বলল, তখন বললেন আমি জজ সাহেব। তাঁকে বিএনপি জজ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। এমনকি ছাত্রদলের দুই নেতা দুই পাশে কাঁধে নিয়ে রায় পড়ে শোনাচ্ছেন, এ রকম জজও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা আইন মানেননি। আমি মনে করি, কোর্টের যে স্যানসিটি, সেই স্যানসিটিটা নষ্ট করা হয়েছে। সবাইকে রক্ষা করার জন্যই কি তিনি এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল চাচ্ছেন? ওটাও তো রাষ্ট্রপতির কাছেই যেতে হবে। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাটাও হাতিয়ে নিয়ে যাওয়া—এটা কোন ধরনের দাবি? এটা কোন ধরনের কথা? আমরা পার্লামেন্টে কোনো আইন তৈরি করতে গেলে একটা মন্ত্রণালয় থাকে, মন্ত্রিপরিষদ বসে, নীতিগত অনুমোদনের পর সেটা ভেটিংয়ে যায়। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ে যায়, সেখান থেকে ভেটিং হয়ে আসে। আমরা অনুমোদন দিই, সেখান থেকে পার্লামেন্টে যায়। পার্লামেন্টে উত্থাপন হয়। বিরোধী দলে যারা থাকে তারা আপত্তি আনে, সংশোধন আনে। সেখান থেকে সংশোধনী কমিটিতে যায়। সেখানে সরকারি, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সবাই থাকে। সেখানে বসে যাচাই-বাছাই হয়। সেখান থেকে আবার পার্লামেন্টে আনা হয়। সংসদ সদস্যরা সেখানে অংশগ্রহণ করে। বিরোধী দল থেকে সেখানে সংশোধনী আনা হয়, কখনো সরকারি দল থেকে সংশোধনী দেওয়া হয়। সংশোধনী দেওয়ার মধ্য দিয়েই সেই আইন পাস করা হয়। ’ তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি লাগে। মেজরিটি দিয়েই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। আর সেটাকে এক কলমের খোঁচায় নাকচ করে দেওয়া, তার মানে এতগুলো সংসদ সদস্য, এতগুলো অফিসার সবাই মিলে যেটা নিয়ে কাজ করল তাদের কারো কোনো জ্ঞানবুদ্ধি নাই। জ্ঞানবুদ্ধি আছে শুধু ওই এক-দুইজনেরই। বিশেষ করে যেই সংশোধনী নিয়ে এখন এত কথা, এত আলোচনা, সেখানেও তো আপিল বিভাগের প্রত্যেকটা জজ সাহেব, সেখানে তাঁরা কতটুকু স্বাধীন মতামত দিতে পেরেছেন সেটা আমি জানি না। সেই সুযোগটা বোধ হয় প্রধান বিচারপতি তাঁদেরকে দেন নাই। যেটা রায়টা পড়লে অনেক কিছু বোঝা যায়। রায়টা পুরো পড়তে আরো কিছুটা বাকি আছে। আমি পুরো রায়টা পড়ব এবং তারপরে আমরা এটা নিয়ে পার্লামেন্টে অবশ্যই আলোচনা করব। ’
আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী যে ভাষায় অ্যাটর্নি জেনারেলকে গালি দিলেন, জঘন্য ভাষা, যে ভাষা মুখ দিয়ে বলতে আমার নিজেরই লজ্জা হয়। সেই ধরনের বক্তব্য দিয়ে দিলেন। আজকে কোর্টের অবস্থাটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা? সেটাই আমার প্রশ্ন। আজকে জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। সে জন্যই তো দেশে আদালত, উচ্চ আদালত। তিনি দেশটা স্বাধীন করতে পেরেছিলেন বলেই তো আজকে এখানে অনেকে বসতে পেরেছেন। ’
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয় কে? মহামান্য রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি যেহেতু প্রধান বিচারপতি আর প্রধানমন্ত্রী এই দুইটা তিনি ইচ্ছামতো নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় যাঁকে নিয়োগ দিলেন তিনি আবার রাষ্ট্রপতির সেই ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাচ্ছেন। যে ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেয় কিভাবে? সেটা দেওয়া হচ্ছে না বলেই যত রাগ আর গোসসা এবং অ্যাটর্নি জেনারেলকে যা তা মন্তব্য করা হচ্ছে। কেন?’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করা এটা তো উচ্চ আদালতের দায়িত্ব না। পার্লামেন্টের মেম্বারদের নিয়ে এ ধরনের অশালীন মন্তব্য করা তো উচ্চ আদালতের দায়িত্ব না। হ্যাঁ, আমরা সবাই বিচার চাইতে যাই। আমরা আশা করি, ন্যায়বিচার হবে। কিন্তু ন্যায়বিচার যাঁরা চাইতে যান তাঁরা যদি গালি খেয়ে আসেন?’ তিনি আরো বলেন, ‘এ কথা ভুললে চলবে না যে জনগণের প্রতিনিধিরাই পার্লামেন্টের মেম্বার। এখানে জনগণ, তারা হচ্ছে ক্ষমতার মালিক। আমাদের যে সংবিধান জাতির পিতা দিয়ে গেছেন, সেই সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে প্রজাতন্ত্রের মালিক হচ্ছে জনগণ। আর জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। ’
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘উনার রায়ে আরো একটি ভুল মন্তব্য দিয়েছেন। উনি বলেছেন, ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত নেয় যে কত দিন পার্লামেন্ট চলবে, কখন চলবে। আমরা পার্লামেন্টে কত দিন চলব, কী চলবে এটা নিয়ে কোনো আলোচনাই করি না। আসলে পার্লামেন্ট প্র্যাকটিস সম্পর্কে যার এতটুকু ধারণা থাকে সে এ ধরনের কথা লিখতে পারে না। পার্লামেন্ট চলে সংবিধান অনুযায়ী, আর এই সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি আছে। সে ভিত্তিতে কার্য উপদেষ্টা কমিটি, কার্য উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান হলেন স্পিকার আর সদস্য সংসদে সরকারি, বিরোধী দলসহ অন্যান্য দলের সংসদ সদস্যরা। প্রত্যেক পার্লামেন্ট বসার আগে পার্লামেন্টের কী কী বিজনেস সেটা এই উপদেষ্টা কমিটিতে বসেই ঠিক করা হয়। কখন বসবে, কত তারিখে বসবে, কয়টার সময় বসবে, কতক্ষণ চলবে সব বিষয়েই কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে আলোচনা হয়েই মাননীয় স্পিকার সিদ্ধান্ত নেন। ক্যাবিনেটের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই। ক্যাবিনেটে কখনো এ বিষয়ে আমরা আলোচনাই করি না। কোনো সিদ্ধান্ত নেই না। এ রকম বহু অবান্তর কথাবার্তা রায়ে দেওয়া আছে। ’
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের আগে প্রধান বিচারপতির তাঁর পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত ছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়ন জাতির পিতা বিশ্বাস করতেন বলেই আমাদের সংবিধানে নারীদের সিট সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। আমরা সেটা ৫০টিতে উন্নীত করেছি। যারা মহিলা এমপি নির্বাচিত হবে তাদের সংসদ সদস্যরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। ইলেকটোরাল কলেজ। সংসদ সদস্যরা তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। এটা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় বহু দেশেই আছে। সেটা নিয়েও আমাদের প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন যে মহিলাদের কেন এভাবে নির্বাচিত করা হয়। ...এখন এটা নিয়েও যদি বিচারপতি তাঁর রায়ে মন্তব্য করেন তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় কিভাবে? রাষ্ট্রপতি তো নির্বাচিত হচ্ছে পার্লামেন্টের মেম্বার দ্বারা। আর সেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতিকে। তাহলে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ নির্বাচন করতে পারবে আর সেই রাষ্ট্রপতি দ্বারাই নির্বাচিত হয়ে চেয়ারে বসেই নিজের নির্বাচনের কথা ভুলে গেলেন!’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সংসদ সদস্য দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, সেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতিকে, উনার (প্রধান বিচারপতি) তো এই কথাগুলো বলার আগে ওই পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত ছিল বা বলেই সরে যাওয়া উচিত ছিল। বলা উচিত ছিল যে এই পার্লামেন্ট যেহেতু মহিলা এমপি নির্বাচিত করতে পারবে না, এই পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে পারবে না, এই রাষ্ট্রপতি যেহেতু আমাকে নিয়োগ দিয়েছে সুতরাং আমি এই পদে থাকব না। ’ তিনি বলেন, ‘রায়ে অনেক কিছু আছে, অনেক স্ববিরোধিতা আছে। এই রায় পড়ে আমার কাছে যা অসংগতিপূর্ণ লাগছে আমি তা নোট নিচ্ছি। আগামীতে পার্লামেন্টে তা বলতে পারব। ’
উচ্চ আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক একটি কথোপকথনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের আদালত সবচেয়ে বড় আদালত। জনগণের আদালতকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আমি শুধু একটা কথাই বলব, পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করা, সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে এটা আমরা কিছুতেই সহ্য করব না। আর পাকিস্তান রায় দিল দেখে কেউ ধমক দেবে, আমি জনগণের কাছে এর বিচার চাই। আমি জনগণের কাছে বিচার চাই যে পাকিস্তানের সঙ্গে কেন তুলনা করবে? আর এসব হুমকি আমাকে দিয়ে লাভ নেই। আমরা আইয়ুব খান দেখেছি, ইয়াহিয়া খান দেখেছি, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া দেখেছি। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোট চুরি করে যারা সংসদ সদস্য হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন এখন বিচারক। কই চিফ জাস্টিস তো তাকে বের করে দেয় নাই। ... আমি শুধু দেশবাসীর কাছে এই বিচারটাই চাই, যে পাকিস্তানকে আমরা যুদ্ধ করে হারিয়েছি, যে পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্র, আজকে সেই পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের তুলনা করবে?’
অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলে বিচার হবে : সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এত উন্নয়ন করলাম সেগুলো নাকি কোনো উন্নয়নই না। তাহলে উন্নয়নটা কিসে? সংবিধান লঙ্ঘন করে কেউ ক্ষমতায় এলে সেটাই উন্নয়ন? সেটা হবে না বাংলাদেশে। আর যা হবে ওই সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে যেটা আছে, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলে তার বিচার হবে। ’
আলোচনাসভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ‘যারা পাকিস্তানের দোসর, রাজাকার, আলবদর, আলশামস তারাই পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে তারা ওদিকে তাকিয়ে থাকবে না। ’ প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে নয়, এ দেশের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। এ দেশে দাঁড়িয়ে বেশি বড় বড় কথা বলবেন না। এ দেশের মানুষ বরদাশত করবে না। ’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অপর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আজকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের উদাহরণ দেওয়া হয়, যে পাকিস্তানে সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে বিচারকরা সহযোগিতা করেছে। আজকে আমাদের দুঃখ লাগে, যখন বলা হয়, এক লোকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। ’ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বিচারপতি স্বাধীন তাঁর বিচার কাজে, এর বাইরে নয়। আজকে উনি আমাদের পাকিস্তান দেখান। কিন্তু পাকিস্তান তো গোরস্থান। উনি প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার হুমকি দেয়। করে দেখেন, কী হয়। আপনি শপথ ভঙ্গ করবেন না। ’
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘পত্রিকায় খবর এসেছে, প্রধান বিচারপতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করে পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ওখানে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রায় দিলেও তো এত আলোচনা সমালোচনা হয়নি। তিনি বলেছেন, আমরা অনেক ধৈর্য ধরেছি। ধৈর্য তো আপনাকে ধরতেই হবে। পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে আমাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এটা পাকিস্তান নয়, এটা বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মানুষ গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু আমরা দেড় দশক সংগ্রাম করে সামরিক শাসন হটিয়েছি। আপনাকে ধৈর্য ধরতেই হবে। না হলে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হবে। ’
তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ‘আমি মনে করি প্রধান বিচারপতি সংসদকে কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অপমান করেছেন। এক নেতার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি মন্তব্য করে জাতির পিতাকে অপমান করেছেন। আমরা এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে চাই। ’
‘বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের আকাশ’ : আলোচনাসভায় কালের কণ্ঠ সম্পাদক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল তারা জানত না মানুষের আত্মাকে ধ্বংস করা যায় না। তারা বোকার মতো অহঙ্কারের বশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের আকাশ। আকাশকে কি কখনো ধ্বংস করা যায়?’
আলোচনাসভায় আরো বক্তব্য দেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, জাসদের (আম্বিয়া) কার্যকরী সভাপতি মঈন উদ্দীন খান বাদল, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। স্বাগত বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ ও আমিনুল ইসলাম আমিন।
No comments:
Post a Comment