ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের পরিকল্পনা নতুন করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত নাগরিকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। মূলত অভিবাসন ঠেকাতে যুক্তরাজ্য সরকার নতুন কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। আর এই খবরই যুক্তরাজ্যসহ ইইউভূক্ত দেশগুলোতে বসবাসরত বাংলাদেশিদেরকেও ভাবনায় ফেলেছে। প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক গার্ডিয়ান যুক্তরাজ্য সরকার কর্তৃক ইইউ নাগরিকদের প্রবেশাধিকার ঠেকানোর পরিকল্পনা সম্পর্কৃত তথ্য তুলে ধরে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রেখে যারা ব্রেক্সিটের পক্ষে কথা বলেছেন এখন তারাও এই গোপন পরিকল্পনায় আস্থা রাখতে পারছেন না। এই বিষয় নিয়ে যুক্তরাজ্যে সংসদ অধিবেশনেও তুমুল বিতর্ক হয়েছে।
তবে অভিবাসনবিরোধী ও ব্রেক্সিটপন্থী রাজনীতিকেরা সরকারের কঠোর নীতির পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। জানা যায় এই পরিকল্পনায় ইইউ নাগরিকদের অধিকার নিয়ে তেমন কোনো বিবেচনাবোধ নেই। যুক্তরাজ্যের এমন অবস্থানে অভিবাসীরাও অবিশ্বাস ও আস্থার সংকটে ভুগছে। যদিও যুক্তরাজ্যে বর্তমানে বসবাসরত অভিবাসীদের তেমন কোন সমস্যায় পড়তে হবে না। যুক্তরাজ্য তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়া মাত্রই ইইউ নাগরিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার বন্ধ করবে। বিশেষ করে অদক্ষ শ্রমিকদের প্রবেশ ঠেকিয়ে ব্রিটিশদের কাজের সুযোগ বাড়ানো হবে। অদক্ষ কর্মীদের কর্ম ভিসা দেওয়া হবে সর্বোচ্চ দুই বছরের। আর দক্ষ কর্মীদের জন্য ভিসার মেয়াদ হবে তিন থেকে পাঁচ বছর। তাদের যুক্তরাজ্যে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ সীমিত করতেই এই ব্যবস্থা।
ইউরোপের অনেক দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের লক্ষ্য থাকে যুক্তরাজ্যের স্থায়ীভাবে বসবাসের। কিন্তু এ অবস্থায় এখন আর তা সম্ভব হবে না। পরিকল্পনায় আরো বলা হয়, ইইউ নাগরিকদের পরিবার আনার ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো সীমারেখা নেই, যে কাউকে তারা পরিবারের সদস্য ঘোষণা করে আনতে পারেন। তবে পরিবারের সদস্যের একটা সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে ব্রেক্সিটের পর পরিবারের সদস্যকে (স্বামী, স্ত্রী বা সন্তান) যুক্তরাজ্যে আনতে হলে ইইউ নাগরিকদের বছরে ১৮ হাজার ৬০০ পাউন্ড আয় দেখাতে হবে। বর্তমানে পরিবার আনতে ব্রিটিশ নাগরিকদের ওই পরিমাণ আয় দেখাতে হলেও ইইউ নাগরিকদের তা করতে হচ্ছে না। বেক্সিট পরবর্তি ইউরোপে অভিবাসী বাংলাদেশিদের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন জার্মান প্রবাসী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এস. এম লুৎফর রহমান। তিনি ভয়েস বাংলাকে জানান, ‘ইউরোপের দেশ ইতালি, স্পেন, ডেনমার্ক থেকে অনেকেই নিরাপদ জীবন যাপনের আশায় যুক্তরাজ্যে স্থায়ী হতে চান।
এখন তাদের জন্য এই ব্যপারটা আর সহজ হবে না।’ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অভিবাসী বাংলাদেশি হোসেন বখতিয়ার ভয়েস বাংলাকে জানান, ‘আমরা নানা ধরণের সমস্যার মধ্যে আছি। বিশেষ করে কারি শিল্পের অবস্থা নিয়েও আমরা শঙ্কিত। তার ওপর বেক্সিট নিয়ে যা হচ্ছে তাতে আমরা যারা অবিবাসী হিসেবে একা এই দেশে আছি তারা হয়তবা প্রিয়জনদের কাছে পাব না। তাদের এ দেশে এখন নিয়ে আসা আরও কঠিন হয়ে যাবে।’ ব্রেক্সিটের পর ইইউ নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশকালে পাসপোর্ট পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ আঙুলের ছাপ (বায়োমেট্রিক ইনফরমেশন) সংরক্ষণের কথা বলা রয়েছে পরিকল্পনায়। মাসখানেক আগে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাম্বার রাড ব্রেক্সিট পরবর্তী অভিবাসননীতি প্রণয়নে সরকারকে পরামর্শ দিতে স্বাধীন সংস্থা ‘ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজরি কমিশন’কে (এমএসি) নিয়োগ দেন। ডিসেম্বর নাগাদ এমএসি মতামত জানানোর কথা। এখন সরকারের বেক্সিট পরবর্তি পরিকল্পনার গোপন তথ্য প্রকাশ হওয়ার ঘটনায় লেবার দলীয় রাজনীতিক ইভেট কুপার প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার যদি গোপনে সব পরিকল্পনা করেই ফেলে তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমএসির কাছে পরামর্শ চাইলেন কেন? ইভেট কুপার সরকারের নেওয়া অভিবাসন নীতিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন।
সরকারের এমন কঠোর অবস্থান ফাঁস হওয়ার ফলে ব্রেক্সিট সমঝোতায় ইইউর বাকি ২৭ দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে প্রতিশোধপরায়নমূলক আচরণ করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এটাও যুক্তরাজ্যে বসবাসে আগ্রহী ইইউ ভূক্ত দেশের অভিবাসী বাংলাদেশিদের চিন্তার আর একটি কারণ। ২০১৬ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে যুক্তরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ইইউর সদস্যপদ ছাড়ার পক্ষে রায় দেয়।
ইইউ নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার বন্ধ করাই ছিল এমন রায়ের অন্যতম কারণ। কিন্তু ইইউ নাগরিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার বন্ধ করলে ইইউর একক বাজারের সুবিধাও হারাবে যুক্তরাজ্য। বাণিজ্য দূরত্ব তৈরি হতে পারে ইইউভুক্ত প্রতিবেশী বাকি ২৭ দেশের সঙ্গে। এ কারণে অভিবাসন ও অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় করে ব্রেক্সিট কার্যকর করতে চাপেও আছে যুক্তরাজ্য।
No comments:
Post a Comment