চলতি বছরটি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্য ‘অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ’ বছর হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটের মধ্যদিয়ে উদ্ভূত ‘নতুন ধাঁচের’ রাজনীতির গতিপথ পাল্টাতে পারে। মোড় ঘুরে যেতে পারে সামগ্রিক রাজনীতির। উদয় হতে পারে নতুন দৃশ্যপটের, ঘটতে পারে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা।
তবে সমঝোতা, বিয়োজন না কাটছাঁট-এটি এখনও আপেক্ষিক। কারণ রাজনীতির দৃশ্যমান পর্দা সাদাকালো মনে হলেও একাধিক বিকল্প নিয়ে নড়চড় ঘটছে পর্দার অন্তরালে। এই নড়চড় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। নড়চড় শেষে শেষ দৃশ্য কী হয়, সেটিই দেখার বিষয়। সব মিলিয়ে বছরটি ঘটনাবহুল হবে– এমন সম্ভাবনার আভাস মিলছে বিভিন্ন সূত্র থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন চলতি বছরে রাজনীতিতে ‘ইতিবাচক’ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখছেন। ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘২০১৬ সালে রাজনীতির সূচনা মোটামুটি আশাপ্রদ। দশম সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে প্রধান দুটি রাজনৈতিক পক্ষ এবার ভিন্ন শিরোনামে উদ্যাপন করলেও তা ছিল শান্তিপূর্ণ। এটা শুভ লক্ষণ। এরপর থেকে রাজনীতি এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল। এর একটি বড় কারণ হলো— সাংগঠনিকভাবে বিএনপি যথেষ্ট দুর্বল। জামায়াতের অবস্থাও কাহিল, দলটির শীর্ষ নেতারা দণ্ডিত-অভিযুক্ত। এর মধ্যে মার্চ-এপ্রিলে বড় দলগুলোর কাউন্সিল অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখছি। সবকিছু মিলিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসার একটা উদ্যোগ আমি দেখছি।’
রাজনীতির অন্দর-মহলের খবরাখবর রাখেন বা রাখার চেষ্টা করেন এমন কয়েকজনের অভিমত, ২০১৬ সাল যে ঘটনাবহুল ও রাজনীতির জন্য খুবই তাত্পর্যপূর্ণ এর কিছু আলামত পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও একেবারে অস্পষ্টও নয়, ধূসর বলা যেতে পারে। চলতি বছরে রাজনীতিতে এক ধরনের ‘সমঝোতা’র আভাস দেখছেন তারা। বিশেষ করে, দশম সংসদ নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিকে ঘিরে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি জোট যেভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে চলে গিয়েছিল, এবার দ্বিতীয় বছরে এসে বিএনপিকে সেখান থেকে ইউ-টার্ন নিতে দেখা গেল।
সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে বিএনপির ‘আপাতত’ বিরত থাকা, এমনকি আন্দোলন নিয়ে দলটির এখন আর তেমন ‘রা’ না করার বিষয়টিও সমঝোতার ইঙ্গিতবহ। এছাড়া পৌরসভা নির্বাচনের পর দলটির নীরবে ফল মেনে নিয়ে চুপচাপ থাকা, নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য না করা এবং সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি নয়াপল্টনের সমাবেশে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সমঝোতাধর্মী বক্তব্যকে ঘিরে এক ধরনের রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিতে। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর বিএনপিকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে দেয়ার মধ্যদিয়ে সরকারেরও বিএনপিকে এক ধরনের ‘স্পেস’ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে সবাই মিলে রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও ছাত্রদলের সভাপতিসহ বিএনপির উল্লেখযোগ্য কয়েক নেতার জামিনে কারামুক্ত হওয়ায় রাজনৈতিক এই রহস্যের ঘনত্ব বেড়েছে। পৌরসভা নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের যে ধরপাকড় চলছিল, সেটিও প্রায় থেমে গেছে। এরমধ্যেই দেশের ভেতরে-বাইরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ কয়েক নেতার যোগাযোগের ঘটনা এই রহস্যকে গভীরতা দিয়েছে।
রাজনীতির অলি-গলির খবর রাখেন, এরকম দু’-একজনের দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা সম্প্রতি লন্ডনে সেখানে বসবাসরত বিএনপির হাইপ্রোফাইল এক নেতার সঙ্গে চা-চক্রে বসেছিলেন। এই চা-চক্রটি ‘হঠাত্ দেখা’ ধরনের বা আকস্মিক ছিল না। পূর্ব যোগাযোগের ভিত্তিতে সময় নির্ধারণ করেই এর আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন ওই উপদেষ্টার এক আত্মীয়, যিনি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সাম্প্রতিক সময়ে ভারতসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশে যাতায়াত ও সেসব দেশে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের খবরও অনেকের জানা।
সূত্রের দাবি, আওয়ামী লীগ-বিএনপির দায়িত্বশীল এসব নেতার দেশে-বিদেশে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল একাদশ সংসদ নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রীর ওই উপদেষ্টা বিএনপির হাইপ্রোফাইল নেতাকে জানান- নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই, বর্তমান সরকারও সেই পথে আর পা বাড়াতে রাজি নয়। সবার অংশগ্রহণে আগাম নির্বাচন চাইলে সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই হতে হবে। বড়জোর নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এসব বিষয়ে সমঝোতা হলে ফলাফলও মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকা অপরিহার্য। বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সায় পাওয়া গেলে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার এসব বক্তব্যের জবাবে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির নেতা বলেছেন ‘আন্দোলন নয়, সবার অংশগ্রহণে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অবাধ নির্বাচনই তাদের মূল দাবি। এক্ষেত্রে আগের কাঠামোর মত পুরোপুরি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালও তারা চাচ্ছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা পাওয়া গেলে সমঝোতার বিষয়ে বিএনপি এগিয়ে আসতে রাজি আছে।’
বিএনপির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- দলের সাংগঠনিক অবস্থা, দলীয় প্রধানসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার গতিপ্রকৃতি, স্থানীয় ও ভূ-রাজনীতির গতিধারাসহ সবকিছু মিলিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে দলটি। মোটামুটি অবাধ নির্বাচন হলে প্রয়োজনে বিরোধী দলে বসতেও তেমন আপত্তি নেই। বিএনপির এই নেতারা আরো জানান, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দলটি এখন সংসদে ফিরতে চায়। সরকার গঠনের সুযোগ পেলে ভালো, তা না হলে অন্তত বিরোধী দল হিসেবে হলেও সংসদে যেতে চায় দলটি। এক্ষেত্রে অন্তত দল বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে আপাতত রক্ষা পাবে বলে মনে করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, চলতি বছরটিকে তাদের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের আগে সংসদ নির্বাচন নয়-মুখে এমন কথা বললেও ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, পৌরসভা নির্বাচন এবং আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর সরকার হয়তো এ বছরেই আগাম জাতীয় নির্বাচনের চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। এই নেতার দাবি, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যেও এই ধরনের বিশ্বাস জন্মেছে। দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাদেরও ধারণা, এ বছর রাজনীতিতে নাটকীয় কিছু ঘটতে পারে।
নতুন নির্বাচন হলে অবাধ
হব না : ড. ইফতেখারুজ্জামান
চলতি বছরকে ঘিরে এমন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে চান না ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইব)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানও। গতকাল মঙ্গলবার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন দেয়ার চিন্তা-ভাবনা সরকারের মধ্যে শুরু থেকেই ছিল। এখনও সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে ঠিক কবে, কখন সেটি বলা কঠিন। এ বছর যদি দেশে একটি জাতীয় নির্বাচন হতে দেখি তাহলে আমি অবাক হব না, আবার না হলেও অবাক হব না।’
সমঝোতার আভাসের পাশাপাশি রাজনীতির পর্দার অন্তরালে বিপরীত কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান বিচার কাজ এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের ও আগামী ৩ মার্চ আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ- সমঝোতার বিপরীত ইঙ্গিত দেয়। দলীয় প্রধানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা নিয়ে বিএনপিও নতুন করে দুশ্চিন্তায়। এছাড়া বিএনপিতে ভাঙ্গন ধরারও নানা আলামত ঘূর্ণায়মান। অন্যদিকে, বিএনপির জোটেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ এরই মধ্যে জোট ছেড়ে গেছে। এর আগে ন্যাশনাল পিপ্লস পার্টির (এনপিপি) একাংশও বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চলতি বছরে বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বাধীন জোটের রাজনীতিতেও নতুন নতুন দৃশ্য দেখা যেতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল শরিক জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল ইক ইনুও দু’দিন আগে বলেছেন, বিএনপি থাকবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। আওয়ামী লীগ নেতা ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিএনপি ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও সম্প্রতি এই ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল-জোটের এসব নেতার বক্তব্যে, অদূর ভবিষ্যতে রাজনীতিতে সমঝোতার পরিবর্তে অন্যকিছুর উপাদান মেলে।
জাতীয় পার্টির রাজনীতি
এদিকে, বর্তমান সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে থাকা এরশাদের জাতীয় পার্টিতে (জাপা) সৃষ্ট অস্থিরতাকে শুধুমাত্র দলটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখছেন না রাজনীতি অভিজ্ঞরা। তাদের মতে, বিএনপির বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কী হবে, সেদিকে প্রখর নজর রেখেছেন এরশাদও। পরিস্থিতির আলোকেই সময়ে-সময়ে তিনি কখনও সরকারের পক্ষে বলছেন, কখনও সরকারকে এক হাত নিচ্ছেন। আবার এরশাদ জাপাকে মন্ত্রিসভা থেকে বের করে আনার কথা বলেও সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছেন বলেও মনে করা হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, পর্দার অন্তরালে কোথাও সরকারের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ হচ্ছে— এমন খবর পাওয়া মাত্রই সরকারের সমালোচনায় জ্বলে ওঠেন এরশাদ। কারণ এরশাদ চান, বিএনপিকে সাইডলাইনে রেখে নিজের দলকে সামনে রাখতে। শুধু এরশাদই নন, ১৪ দলের দু’-একটি শরিকও এই কৌশল নিয়েছে। রাজনীতিতে বিএনপিকে ‘স্পেস’ দেয়ার পক্ষে নন তারা। তাদের ধারণা, বিএনপিকে ছাড় দেয়া হলে রাজনীতিতে তারা আবারও গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারেন। মোট কথা, সবাই যার যার কৌশলে খেলছেন। এই খেলার একটি ফলাফল দেখা যেতে পারে এ বছর। তবে সেই ফলাফল কী হতে পারে, সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।
No comments:
Post a Comment