সাদা হাতির দেশ নামে পরিচিত থাইল্যান্ড মূলত পর্যটকদের কাছে নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে যান দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। আর এসব পর্যটকদের উপর নির্ভর করে থাইল্যান্ডে গড়ে উঠেছে নানা ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, গার্ডেন, ট্রাভেলসসহ বড় বড় সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব ব্যবসার সাথে জরিতরা অধিকাংশই ভারত, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের নাগরিক।
সম্প্রতি থাই সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলে পর্যটন শিল্পে এক ধরণের ধীরগতি নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের শঙ্কায় পর্যটকদের প্রতি এক ধরণের বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে থাই সরকার। তাই বিশ্বের সব দেশের নাগরিকদের ট্যুরিষ্ট ভিসা নিয়ে থাইল্যান্ডে অবাধ বিচরণের সুযোগ এখন আর নেই।
ফলে থাইল্যান্ডে ট্যুরিষ্ট ও হোটেল ব্যবসায় এক ধরণের মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে বাংলাদেশসহ ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। কারন সিজন্যাল কিংবা প্যাকেজ ভ্রমনে পর্যটকদের পর্যাপ্ত আনাগোনা না থাকলেও হোটেল ট্যাক্স ও লিভিং কস্ট গুনতে হচ্ছে সমান তালে। তবে এর মধ্যেও হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান সুনামের সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছে বলে জানান থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোজাফফর হোসাইন দিপু।
এই ব্যবসায়ী বলেন, তিনি প্রায় চার বছর ধরে থাইল্যান্ডে কার্গো লিভিং ব্যবসায়ের সাথে জড়িত আছেন। তিনি জানান, ‘থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীসহ যেসব ভারতীয় ব্যবসায়ী রয়েছে, তারা মূলত থাইল্যান্ডে রেস্টুরেন্ট ও ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করছে। এর বাইরে অল্প সংখ্যক ব্যবসায়ী রয়েছে যারা জাহাজ, প্রসাধনী ও টেইলার্স ব্যবসার সাথে জড়িত। তবে ট্যুরিষ্টদের আনাগোনা দেশটিতে বেশি বলে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরা ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করে থাকে।
থাইল্যান্ডে ব্যবসায়ীদের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে মোজাফফর হোসাইন দিপু জানান, বর্তমানে থাইল্যান্ডে সামরিক সরকার থাকার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে শুধু যে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বিপদে আছে এমন নয় ; বরং সব দেশের ব্যবসায়ীরাই বিপদে আছেন। তবে সবাই অপেক্ষা করছে সরকার পরিবর্তনের।
হোটেল ব্যবসায় বাংলাদেশিদের অবস্থান জানতে চাইলে এই প্রবাসী বলেন, থাইল্যান্ডের সুকুমভি সয় এলেভেন নামে পর্যটন এলাকায় বেশ কিছু বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রয়েছে। যারা ট্যুর ও ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে অনেক আগে থেকেই ব্যবসা করে আসছে। যে এলাকায় তারা ব্যবসা করছে সেখানে চার থেকে পাঁচটি কোম্পানি ব্যবসা করার মত সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি আরো কিছু বাংলাদেশি ব্যবসায়ী সেখানে গিয়ে প্রতিষ্ঠান খোলায় সেখানকার পুরাতন ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় অনেকটা মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। তাই থাই সরকারের বাইরে নিজ কমিউনিটির মানুষেরাও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ের মন্দাভাভের জন্য অনেকটাই দায়ী বলে মনে করেন এই থাই প্রবাসী।
মোজাফফর হোসাইন দিপু আরো জানান, বেশ কিছু বাংলাদেশি ব্যবসায়ী থাইল্যান্ডে ট্যুর ও ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ব্যাংকক থেকে ২শ কিলোমিটার দূরে নয়নাভিরাম পর্যটন বিকশিত এরিয়া ‘পাতাইয়ায়’ ট্যুর এন্ড ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করেন নোয়াখালীর বাবুল উদ্দিন। ‘সিয়াম হলিডেজ’ নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দীর্ঘদিন তিনি পর্যটকদের সেবা দিয়ে আসছেন। তার এজেন্সির সেবায় মুগ্ধ বাংলাদেশি পর্যটকসহ দ. এশিয়ার পর্যটকরা।
থাইল্যান্ডে ‘এবিএম গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড’ অধীনে হেলাল উদ্দিনের আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মূল প্রসার সিয়াম হলিডেজ থেকে শুরু হয়েছে।
পর্যটন শিল্পের বাইরে শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশি নাগরিকদের থাইল্যান্ডে প্রবেশ করার সরকারি কোন চুক্তি নেই। তবে ব্যবাসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে তার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া শ্রমিক যাওয়ার প্রবণতাও দেশটিতে খুব কম। কেননা দেশটির মুদ্রা মানের দিক থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার মান কাছকাছি। এর মধ্যেও যারা থাইল্যান্ডে শ্রমিক হিসেবে আছেন তারা মূলত মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরের মত দেশে প্রবেশ করতে গিয়ে কোন না কোনভাবে সেখানে আটকা পড়ে থেকে গেছে। কারন মানবপাচারকারী চক্রদের কাছে থাইল্যান্ড বরাবরই আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত থাইল্যান্ডে সুকুম্ভিটের সয় ১-১৩ নম্বর রোড পর্যন্ত ১৩টি, ওল্ড টাউনে ২টি, প্রাতুনামে ১টি, ফাওয়াতে ২টি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট ছিল। এছাড়াও ব্যাংককে রয়েছে ২০০টির বেশি বাংলাদেশি টেইলার্স। রয়েছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরাও। এর বাইরে সিলেট থেকে কিছু ব্যবসায়ী সেখানে প্রসাধনীর ব্যবসা করেন। ১৯৮০ সালের পরে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা শুরু করেন থাইল্যান্ডে। কিন্তু পর্যটন নির্ভর এই দেশটিতে পর্যটক কেন্দ্রীক ব্যবসা সবচেয়ে বেশি লাভজনক হওয়ায় সেদিকে বেশি উৎসাহী ব্যবসায়ীরা।
উল্লেখ্য, দেশটিতে দীর্ঘ সময় সামরিক শাসন ও বিশ্ববাপী সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ায় মাঝে মধ্যে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে পার করেছে সেখানকার প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। তবে এখন যারা ব্যবসা করছেন তাদের অনেকে সেদেশের আইন-কানুন না জেনে কিছু ভুয়া এজেন্টের সাথে শেয়ারে ব্যবসা করছেন। যাদের অধিকাংশ থাই নাগরিকদের কোন ধরণের ব্যবসায়িক অনুমোদন নেই। কেননা থাইল্যান্ডে ব্যবসা করতে হলে সেদেশে আইন অনুযায় ৫১% শেয়ার থাই ব্যবসায়ীর হতে হবে। যার কারণে অনেকেই না বুঝে ব্যবসা শুরু করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
তবে এরই মধ্যে থাইল্যান্ডে ব্যবসায়িক প্রসার ঘটাতে দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রশংসা করেছেন সেখানকার অনেক প্রবাসী ব্যবসায়ী। তারা জানান, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা যাতে থাইল্যান্ডে নিরাপদে ব্যবসা করতে পারে সেজন্য থাই সরকারের সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশ দূতাবাস। এছাড়া আগামীতে ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াও দু-দেশের মধ্যে যাতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারেও কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন দূতাবাস প্রধান।
No comments:
Post a Comment