- মালয়েশিয়ায় বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ স্থগিত
- বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর প্রচেষ্টায় বড় ধাক্কা *ফেরত পাঠাবে অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদেরও *সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি
বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নিতে চুক্তি করার একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত বদল করেছে মালয়েশিয়া সরকার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আপাতত কোনো কর্মী নেবে না তারা। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশি কর্মীদেরও দ্রুত নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে তারা জানিয়েছে। অথচ মাত্র একদিন আগেই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। একদিন পরই মালয়েশিয়ার এমন ঘোষণা বাংলাদেশি কর্মীদের হতাশ করেছে। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন পর মালয়েশিয়ায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণের প্রচেষ্টা বড় ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ঢাকায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শ্রমিক না নেয়ার বিষয়ে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি প্লাস এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও মালয়েশিয়ার পক্ষে দেশটির মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী রিচার্ড রায়ট আনাক জায়েম এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির ফলে দেশটিতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণের পথ সুগম হয়।
চুক্তির পর দুই দেশের মন্ত্রীরা জানান, আগামী তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হবে মালয়েশিয়ায়। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিও কর্মী পাঠাবে। বনায়ন ছাড়াও সেবা, নির্মাণ, কৃষি ও উত্পাদন খাতে বাংলাদেশি কর্মী নেবে তারা।
এই পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় যেতে খরচ হবে ৩৪ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশের কর্মীদের সর্বনিম্ন বেতন হবে শহর ভেদে ৮০০ থেকে ৯০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা)। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কর্মীরা যাওয়া শুরু করবে বলে মালয়েশিয়ার মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান। অথচ চুক্তির একদিন পর গতকাল শুক্রবার মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী দাতুক আহমেদ জাহিদ হামিদি বলেছেন, আপাতত বিদেশ থেকে কোনো কর্মী নেবে না তার দেশ। মালয়েশিয়ার স্টার অনলাইনের খবরে বলা হয়, আহমেদ জাহিদ এখন দেশটির কোটা সামারান এলাকায় রয়েছেন। সেখানে তিনি মালিকদের স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার অনুরোধ করে বলেছেন দেশটিতে থাকা অবৈধ শ্রমিকদের আটক করে দ্রুত নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। তিনি বলেন, শ্রমিক নেয়া বন্ধে মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে।
মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী জাহিদ হামিদি একইসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। তিনি আশা করেন, সেদেশের তরুণরা সরকারের সিদ্ধান্তে সাড়া দেবে এবং বিদেশিদের কাছে থাকা কাজে নিজেরা অংশ নিয়ে দেশের অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখবে। মালয়েশিয়ার বার্তা সংস্থা বারনামা জানিয়েছে, এক বৈঠকের পর উপপ্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি সব ‘সোর্স কান্ট্রি’ থেকে কর্মী নেয়া স্থগিত রাখার এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, এখন আমাদের কত শ্রমিক প্রয়োজন, সে বিষয়ে সরকার সন্তোষজনক তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কর্মী নেয়া স্থগিত থাকবে।
মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী কর্মী নেয়া বন্ধের কথা জানালেও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে কিছুই জানানো হয়নি। চুক্তির একদিন পরই মালয়েশিয়া কেন সিদ্ধান্ত বদল করেছে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুই দেশের মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছে। কিন্তু তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী না নেয়ার বিষয়ে আমাদেরকে এখনো কিছুই জানায়নি। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে তখনই বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে।’
অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের শ্রম কাউন্সিলর সাইদুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘মালয়েশিয়া আপাতত শ্রমিক নেবে না বলে আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি। এখানকার সরকার বিদেশি শ্রমিক নিয়োগে দুই স্তরের লেভি (এক প্রকার কর) কর্মসূচি পুনর্বিবেচনা করতে চায়। এই পর্যালোচনার পরই তারা শ্রমিক নেয়া শুরু করবে।’
বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির আগেই বিদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে। বৃহস্পতিবার বারনামার এক খবরে বলা হয়, মালয়েশিয়ার ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এমটিইউসি) বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে সরকারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। তারা জানায়, সরকার যদি উচ্চ-আয়ের দেশের সুনাম অর্জন করতে চায় তবে বিদেশি শ্রমিক আনার সংখ্যা অবশ্যই কমাতে হবে। বিদেশের কর্মীদের উপর মালয়েশিয়ার নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার দেশটির সাবাহ রাজ্য সরকার জানিয়েছিলো তারা বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজে নেবে না। এটা তাদের স্পষ্ট নীতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি কর্মীদের ওপর নির্ভরতা কমাতে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে সিদ্ধান্ত বদল করতে পারে মালয়েশিয়া সরকার। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে কর্মী নিতে চুক্তির একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত বদলের জন্য মালয়েশিয়া সরকারের সমালোচনা করেছেন দেশটির সাবেক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ক মন্ত্রী তান রাফিদা আজিজ। তিনি চুক্তির একদিন পর বিদেশি শ্রমিক নেয়া বন্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
কর্মী প্রেরণে অব্যবস্থাপনার কারণে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। এরপর ২০১২ সালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি (সরকারিভাবে) প্রক্রিয়ায় কর্মী প্রেরণের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। কিন্তু এই পদ্ধতিতে জনশক্তি রপ্তানির লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এ কারণে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে এই জিটুজি প্লাস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে। আর ধারণা করা হয়, অবৈধভাবে সেখানে আছেন দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি। যদিও মালয়েশিয়া সরকার সম্প্রতি জানিয়েছিলো দেশটিতে অবস্থানরত অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। আশা করা হচ্ছিলো, বাংলাদেশের দুই লাখ কর্মী সেখানে বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে। কিন্তু দেশটির সরকারের নতুন ঘোষণা তাদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।


No comments:
Post a Comment