আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো হিমায়িত খাদ্য বা মাছ। প্রতিবছর বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে মাছ রপ্তানি করে এ খাত থেকে কয়েক হাজার মার্কিন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যা, জলচ্ছাসের কারণে মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ খাত থেকে রপ্তানি আয় কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি আয় কমছে এ খাতে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬৩ কোটি ডলারের মাছ রপ্তানি হয়। পরের দুই অর্থবছরে তা যথাক্রমে ৫৬ কোটি ডলার ও ৫৩ কোটি ৫৮ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) হিমায়িত ও জীবিত মাছ রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৫২ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের চেয়ে এক দশমিক ৭৪ শতাংশ কম।
অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও তা দুই দশমিক ৬৯ শতাংশ কম। অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। বিশ্বে মাছ রপ্তানি কমে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়াকেই উল্লেখ করছেন হিমায়িত মাছ রপ্তানিকারকরা। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে চিংড়ির উৎপাদন কমছে। অন্যদিকে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশ মাছ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় সামগ্রিকভাবে হিমায়িত খাদ্য রপ্তানি কমছে বলে তাদের অভিমত। রপ্তানিকারকরা বলছেন, উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চিংড়ি চাষযোগ্য এলাকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন করা দরকার। এ ছাড়া বাড়তি ফলনের জন্য বিশেষ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে ভেন্নামী জাতের চিংড়ি চাষের অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। সেটা না করতে পারলে প্রতিযোগী দেশগুলো অনেক এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্যে দেখা গেছে, দেশে প্রায় পৌনে তিন লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ির চাষাবাদ হয়। যেখানে বছরে ২ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। চিংড়ি ও মাছ প্রক্রিয়াকরণের জন্য সারা দেশে ৭০টি কারখানা আছে। চিংড়ি রপ্তানি কমলেও বিশ্বের অনেক দেশে শুটকি ও ইলিশ রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে। জিআই পণ্য হিসেবে কাতার,সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইলিশ এবং শুটকি রপ্তানি আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে অর্থনৈতিকভাবে হিমায়িত মাছ হিসেবে চিংড়ির বাজারই বিশ্বে সবচেয়ে বড়। তাই চাহিদার তুলনায় যোগান না দিতে পারায় সামগ্রিকভাবে এ খাতে প্রভাব পড়েছে বলে জানান রপ্তানিকারকরা। বিএফএফইএ সাবেক সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, মাছ রপ্তানি করতে হলে আগে উৎপাদন করতে হবে। আর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি কোন পদক্ষেপ নেই। ফলে উৎপাদনও বাড়ছে না, কমে যাচ্ছে রপ্তানি আয়। সরকারের পক্ষ থেকে মৎস্য অধিদপ্তরের কেউ এদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মোট হিমায়িত ও জীবিত মাছ রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ এসেছে চিংড়ি রপ্তানি থেকে। অবশ্য এক্ষেত্রে আগের অর্থবছরের চেয়ে আয় কমেছে। গত বছরে চিংড়ি রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ৪৪ কোটি ৮৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার। যা এর আগের বছরের চেয়ে এক দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ১৯ শতাংশ কম। চিংড়ি বাদে অন্যান্য হিমায়িত মাছ রপ্তানি হয়েছে চার কোটি ৪০ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ছয় দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আট দশমিক ২৫ শতাংশ কম। অবকাঠামো,উৎপাদন এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় যদি সরকারি কিংবা বেসরকারি পযায়ে উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে এ খাত থেকে আরও বেশি পরিমান অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা বাংলাদেশের চিংড়ি, ইলিশ এবং শুটকির চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি । বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি মাছের চাহিদা এবং সুখ্যাতি রয়েছে ব্যাপক।
কাতার প্রবাসী সাংবাদিক কাজী শামীম জানান,ভারত,ফিলিপিন্স এবং পাকিস্তান থেকে যে পরিমাণ মাছ কাতারে প্রবেশ করে তার চেয়ে অনেক কম পরিমান মাছ বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়। কিন্তু কাতারিদের কাছে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা ও সুখ্যাতি বেশি । তিনি আরও বলেন, যদি সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা দিয়ে ব্যবসায়ীদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হয় তাহলে কাতার হতে পারে বাংলাদেশি মাছের অন্যতম বাজার।


No comments:
Post a Comment