*আগুন দেওয়া চলছেই *প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব প্রশ্নের সম্মুখীন *ঘরে ঘরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের চলে যেতে বলছে সেনাবাহিনী
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ফের বেড়েছে। খাদ্য সংকট, নির্যাতন-নিপীড়ন ও হামলা আতংকে গ্রামের পর গ্রাম রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে পড়েছে। প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে। অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগ তীব্রতর করেছে। খবর এএফপির।
এদিকে রাখাইনের কয়েকশ’ গ্রামে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালানোর প্রমাণ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটি জানিয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বেছে বেছে পুরুষ ও কিশোরদের গুলি ও ছুড়িকাঘাত করে হত্যা করেছে। রোহিঙ্গা নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে।
মাঝে কিছুদিন রোহিঙ্গাদের আগমন একটি স্থিতিবস্থায় থাকলেও এখন প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা আসছে। বাংলাদেশে প্রবেশের উদ্দেশে দশ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় জড়ো হয়েছে বলে জানা গেছে।
নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়ার কারণ হিসেবে সদ্য আসা রোহিঙ্গারা বলছে, রাখাইন রাজ্যের পশ্চিম অংশে যেসব রোহিঙ্গা রয়ে গিয়েছিল তাদের সরিয়ে দিতে নতুন করে অভিযান শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিন যেসব এলাকায় সহিংসতা হয়েছিল, এসব এলাকা ছিল তা থেকে মুক্ত।
গত কয়েক সপ্তাহে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যের অর্ধেক রোহিঙ্গা পালিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় আরো অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে।
গত সোমবার বাংলাদেশে আসা রাশিদা বেগম জানান, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে স্থানীয় কর্মকর্তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছিল। তারা বলেছে, যদি আমরা গ্রামে থেকে যাই, তাহলে নিরাপদ থাকব। কিন্তু পরে সেনাবাহিনী ঘরে ঘরে আসে। বলল আমরা যেন দেশ ছেড়ে চলে যাই। গত শুক্রবার মংডুতে রোহিঙ্গা উচ্ছেদের বর্ণনা দিয়ে রাশিদা আরো বলেন, সেনাবাহিনী বলেছিল, আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু বাস্তবে তারা আমাদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিল। রাশিদা বেগম তার মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
এদিকে মিয়ানমারের গণমাধ্যম বলছে, রোহিঙ্গারা নিরাপদে থাকবে-এমন নিশ্চয়তা দেওয়া সত্ত্বেও তারা স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ছে।
শাহ পরীর দ্বীপে হাসিনা খাতুন (২৫) জানান, আমি চেয়েছিলাম আমার গ্রামে থেকে যেতে। স্থানীয় কর্মকর্তারা আমাদের বাংলাদেশে যেতে নিষেধ করেছিল। বলল, সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তাদের বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। শেষমেষ আমাদের দেশ ছাড়তেই হলো।
ফজলুল হক নামে স্থানীয় একজন কাউন্সিলর জানান, সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে নৌকাবোঝাই মানুষের আগমন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমপ্রতি এই প্রবাহ আবার শুরু হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও বলপ্রয়োগের অভিযোগ করেছেন। জাতিসংঘ গত মঙ্গলবার জানায়, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫ লাখ ৯ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে।
গ্রাম খালি করার জন্য সেনাবাহিনীর নির্দেশ পাওয়ার পর গত রবিবার বাংলাদেশে আসেন নুরুল আমিন। তিনি বলেন, সাপের মতো একেবেঁকে এক সারি রোহিঙ্গাকে তিনি উপকূলের দিকে যেতে দেখেছেন। তিনি আরো বলেন, আমরা যখন গ্রাম ছাড়ি, চারদিক থেকে গ্রামবাসীরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। সেনাবাহিনী কাউকে হত্যা করছে না, শুধুমাত্র বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে বাড়িঘরে আগুনের কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের প্রমান পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গতকাল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর সেনাবাহিনীর যৌন নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের নতুন তথ্য পেয়েছে তারা। রাখাইনের মাউং নু গ্রামে গত ২৭ আগস্ট সেনারা কয়েকশ’ রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেদিন সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে নিরাপত্তার জন্য একটি আবাসিক কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেওয়া গ্রামবাসীদেরকে পিটিয়ে, যৌন নিপীড়ন চালিয়ে, ছুরিকাঘাত এবং গুলি করে হত্যা করেছে সেনারা। তারা বেছে বেছে পুরুষ ও কিশোরদের গুলি, ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে। পরে সেনারা মৃতদেহগুলো সামরিক ট্রাকে করে দূরে নিয়ে যায়। কোনও কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, এই ট্রাকগুলোতে শত শত মরদেহ ছিল।
সংস্থাটি আরো বলেছে, স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে মাউং নু এবং পার্শ্ববর্তী হপং তো পিন গ্রাম প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। মাউং নু এবং আশেপাশের গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে বেঁচে গেছে এবং ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এমন ১৪ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে এইচআরডব্লিউ।
উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, মরিচ্ছং পাড়ার চেয়ারম্যান শামশুল আলম বলেন, তার দোতলা একটি কাঠের ঘর, দুই শতাধিক গরু মহিষের খামার ছিল। গত মঙ্গলবার সকালে সেনাবাহিনী ওই গ্রামে প্রবেশ করে শতাধিক বাড়িঘর আগুন দেয়। তার বাড়িটিও পুড়িয়ে দেয়। এসময় গরু ও ছাগলগুলো জান্তারা লুটপাট করে নিয়ে যায়। রোহিঙ্গারা জানায়, মূলত রোহিঙ্গা গ্রামগুলো সেনারা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। এখন তাদের চলে যেতে বলছে।
Wednesday, October 4, 2017
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment