প্রতিবছর প্রচুর বাংলাদেশি ভাগ্য অন্বেষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে। তবে বেশিরভাগ অভিবাসীর বৈধ কাগজপত্র ও কারিগরি প্রশিক্ষণ না থাকায় প্রবাসে গিয়েও ভালো আয় করতে পারছে না তারা। তার প্রাথমিক সমস্যাটা হলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ভাষা শ্রমিকদের আয়ত্বে না থাকা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদেশে কারিগরি প্রশিক্ষণ না নিয়ে শ্রমিকরা প্রবেশ করলেও পরবর্তীতে যে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করবে, তার প্রধান অন্তরায় হলো ভাষার উপর দক্ষতা না থাকা। ফলে অন্য দেশের শ্রমিকদের চেয়ে বেশ পিছিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকরা। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে তাদের উপার্জিত আয়ে। একই ধরনের কারিগরি ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কাজ শুরু করলেও শুধু ভাষার দক্ষতায় বাংলাদেশীদের চেয়ে বেশি উপার্জন করছেন অন্যান্য দেশের প্রবাসী শ্রমিকরা।
ভাষা দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশিরা অন্যদেশ থেকে কম আয় করার বিষয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্র্যাসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের ৮১ শতাংশই কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু এসব দেশের প্রচলিত ভাষায় (আরবি) দক্ষ নন বাংলাদেশিরা। অনেক ক্ষেত্রে ভাষাগত দক্ষতার অভাবে এসব শ্রমিকদের নিম্ন বেতনের কাজ করতে হচ্ছে দেশটির বিভিন্ন কোম্পানীতে। অথচ একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে শুধু আরবি ভাষা জানার কারণে ইরাক, সুদানের প্রবাসী কর্মীরা সেখানে আয় করছেন প্রায় দ্বিগুণ। আর এই জটিলতা দূর করতে কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ভাষাগত শিক্ষারও গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ শ্রমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম। শিক্ষার পাশাপাশি ভাষাগত দুর্বলতা, পরিশ্রমী ও আত্মপ্রত্যয়ী না হওয়ায় তাদের পদোন্নতিও হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে কম মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে মাসের পর মাস। অন্যদিকে ভারত বা শ্রীলংকা থেকে যাওয়া শ্রমিকরা শিক্ষা ও ভাষাগত দক্ষতার কারণে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম দিকে সাধারণ কর্মী পদে যোগদান করলেও ভাষাগত দক্ষতার জোরে ব্যবস্থাপনা পদে চাকরিতে উন্নীত হচ্ছেন তারা। ফলে বাংলাদেশীদের তুলনায় তাদের আয়ও হচ্ছে অনেক বেশি। ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রবাসীদের ভাষা প্রশিক্ষণের গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে। বৈঠকে বলা হয়, বিদেশ গমনেচ্ছুদের ভাষার প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে পাঠিয়ে সেখানকার বাজার ধরার জন্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে রেমিট্যান্স বাড়ানোই ভাষা শিক্ষা প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ৩৪টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে বিদেশগামী কর্মীদের কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যবহারিক ভাষা শিক্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগিরই ঢাকায় তিনটি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে রুশ ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি জাপানি ভাষা শিক্ষার জন্য সে দেশের সরকারের অর্থায়নে ও জাইকার সহায়তায় প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপনেরও পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)। সংস্থাটির মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কোরিয়াগামী ৪৮৮ জন কর্মীকে কোরিয়ান ভাষায়, হংকংগামী ১ হাজার ৩১২ জনকে ক্যান্টনিজ ভাষায় ও ২৬৯ জনকে ইংরেজি ভাষায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আরবি ভাষার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যগামী ৭৩ হাজার ৬২৩ জন। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়া প্রতি বছরই বাড়ছে। ২০১৫ সালে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন বাংলাদেশী বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমালেও ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জনে। আর চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি। তবে দিনদিন জনশক্তি রফতানি বাড়লেও বাড়ছে না রেমিট্যান্স প্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণ ১৪ শতাংশের বেশি কমেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর প্রবাসীরা ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার দেশে পাঠালেও গত অর্থবছর পাঠিয়েছেন ১ হাজার ২৭৭ কোটি ডলার। তাই দেশের রেমিটেন্স বৃদ্ধি ও বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে আরো শক্তিশালী করতে বিদেশগমন বাংলাদেশিদের কারগরিক দক্ষতার পাশাপাশি ভাষা দক্ষতার দিকেও জোর নজর দিতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
No comments:
Post a Comment