মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ১১ আগস্ট সেনা মোতায়েনের পর ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান। নির্বিচারে গণহত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের এ অভিযানের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র যে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো অতীতের সকল বর্বরতা হার মেনেছে। প্রাণ বাঁচাতে পাশ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৫ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা; যাদের ৯০ শতাংশই শিশু-নারী-বৃদ্ধ। মিয়ানমারের এ ঘৃণ্য তৎপরতা ইতিহাসে ‘নৃশংসতম গণহত্যা’র উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করে জাতিসংঘ এ অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
অভিযান শুরুর পর ঠিক কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তা নির্দিষ্ট করে কেউই বলতে পারছে না। মিয়ানমার সরকার এ সংখ্যাকে শ’ খানেক বলে দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে। যদিও কিছুদিন আগে ঢাকায় কূটনৈতিকদের কাছে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী রাখাইনে সেনা অভিযানে গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের সংখ্যা তিন হাজার বলে উল্লেখ করেছেন। তবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা নিহতের সংখ্যা এর চেয়ে শত-সহস্রগুণ বলে দাবি করেছে।
এর আগে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি পর্যালোচনার মাধ্যমে নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডব্লিউ জানায়, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দমন-নিপীড়ন অভিযানের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে বাড়িঘরে পুনরায় ফিরতে না পারে, সে জন্য বার্মার নিরাপত্তা বাহিনী গ্রামগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ দেখা যাচ্ছে। সেনাদের দেওয়া আগুনে রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষ্যিত ২১৪টি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে।’
পরবর্তীত মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দফতরের মুখপাত্র জ্য তে রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানান, ‘রাখাইন রাজ্যের তিনটি শহরতলির সর্বমোট ৪৭১টি গ্রামের মধ্যে ১৭৬টি গ্রাম এখন জনমানবশূন্য। অন্য ৩৪টি গ্রাম থেকেও কিছু কিছু লোক প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে গেছে।’
এদিকে জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাবানুযায়ী ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা হত্যা অভিযান শুরুর পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ৫ লাখ ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যদিও বেসরকারি হিসাব মতে, এই সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখের মতো। প্রশ্ন হচ্ছে, রাখাইনের মাত্র ৮ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আর কতজন সেখানে অবস্থান করছেন?
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও) এর হিসাবে, ১৯৭০-এর দশক থেকে একের পর এক রোহিঙ্গা হত্যা-নির্যাতন অভিযানে ১৯৭০-২০১৭ সাল পর্যন্ত ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে রাখাইন বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশসমূহে পালিয়ে গেছে। যা রাখাইনের মোট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুসারে ১৯৭০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ৮৪ শতাংশ বা ১৬ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন ছেড়ে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে। সে হিসেবে রাজ্যটিতে এখন ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা থাকার কথা। ইউরোপীয় কমিশনের প্রকাশিত একটি রিপোর্টের তথ্যানুসারেও দেখা যায়, ২০১৭ সালের শুরুতে অর্থাৎ নতুন করে রোহিঙ্গা কিলিং মিশন শুরুর আগে রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ৮ লাখ। ইতোমধ্যে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। অতএব রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ তিন লাখ রোহিঙ্গা থাকার কথা।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে সেখানকার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ আর পালিয়ে আসার পর রাখাইনে অবশিষ্ট ৩ লাখ রোহিঙ্গার ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা বিশ্ব গণমাধ্যমে অজানা। তাই প্রকৃতপক্ষে রাখাইনে আর কতজন রোহিঙ্গা বেঁচে আছে তা নির্ভর করছে, মিয়ানমারের বর্বর সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা ঠিক কতজন রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে তার ওপর।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা একটি নৃগোষ্ঠীর নাম যাদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ইসলাম ও ১০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। রোহিঙ্গাদের আদি আবাসস্থল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। শত শত বছর ধরে রাজ্যটিতে বাস করা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে মিয়ানমার সরকার এ জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালাচ্ছে।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার সময়ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছিল। ১৯৬২-তে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার পর নতুন করে সংকটের মুখে পড়ে রোহিঙ্গারা। ১৯৭৪ সালে সামরিক জান্তা ‘বিদেশি’ আখ্যা দেওয়ার পর ১৯৮২ সালে প্রণোয়ন করা হয় নাগরিকত্ব আইন। আর এই কালো আইনের মাধ্যমে অস্বীকার করা হয় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব।
২০১৬ সালের অক্টোবরের পর পুনরায় চলতি বছরের গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরু করে। অভিযানে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে পালিয়ে আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলার সময় এখনও হয়নি জানান সংস্থাটির মুখপাত্র।
অভিযানের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি পুরিয়ে দেওয়া, কুপিয়ে হত্যাসহ বর্বরতার চূড়ান্ত সীমাও অতিক্রম করেছে বলে অভিযোগ নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইচ ওয়াচের। সংস্থাটির অভিযোগ, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে।
No comments:
Post a Comment